নতুন শপথে বিজয় উদযাপন

আজ বাংলাদেশের ৪৯তম বিজয় দিবস। পাকিস্তানিদের পরাজিত করার বার্ষিকী উদযাপন করছি আমরা। পাকিস্তানি শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার অহংকারই এই দিনটার মূল তাৎপর্য। তবে সেটুকুতেই আমরা আটকে থাকব, না মুক্তির আলোকে আরো নতুন প্রতিজ্ঞা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব, সেই ভাবনার সময় এসেছে।
তবে এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একটি বড় অর্জন আছে বলতে হবে। দেরিতে হলেও একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে কাজ করা রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার। রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রাথমিক তালিকায় ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের নাম প্রকাশ করেছেন। এটি নতুন কোনো তালিকা নয়। বরং রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে যাঁরা ভাতা নিয়েছেন বা যাঁদের নামে অস্ত্র এসেছে, তাঁদের নাম-পরিচয় ও ভূমিকাসহ তালিকা সেই ১৯৭১ সালেই জেলাসহ স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেই রেকর্ড সংগ্রহ করে এই তালিকা করা হয়েছে।
একদিকে যখন রাজাকারের তালিকা হচ্ছে, তখন অন্যদিকে রাজাকারের নতুন আস্ফালনও দেখছি আমরা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক সহকারী মহাসচিব আব্দুল কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে দৈনিক সংগ্রাম গত বৃহস্পতিবার তার প্রথম পাতায় ‘শহীদ কাদের মোল্লার ৬ষ্ঠ শাহাদাত বার্ষিকী আজ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা শুক্রবার ঢাকার মগবাজারে পত্রিকাটির প্রধান কার্যালয়ে যায় এবং পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক আবুল আসাদকে অফিস থেকে বাইরে নিয়ে এসে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ তাঁকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে এখন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
এই ঘটনায় একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, দৈনিক সংগ্রাম ১৯৭১-এ যেমন জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাস, সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে খুন, নারী নির্যাতন, ধর্ষণের সমর্থক ছিল, এখনো সেই ভূমিকা থেকে এতটুকু সরে আসেনি।
এত লড়াই, এত ত্যাগ স্বীকার করে খুব কম জাতিই পৃথিবীতে স্বাধীনতা পেয়েছে। অথচ এ দেশেরই কিছু গোষ্ঠী একাত্তরে যেভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল। আজও তারা সে পথেই আছে। তাই বিজয় দিবস উদযাপন শুধু স্মৃতি-নির্ভর, শপথ-নির্ভর নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান জানিয়ে যদি আমরা শপথ নিতে পারি সহিংস, সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, তা হলেই দিনটাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। আর সংগ্রামে জিততে পারলে আমাদের প্রত্যেকের স্বাধীনতার অগ্রগতি হয়।
বর্তমান প্রজন্ম একাত্তরের লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে মহান বিজয় দিবস বর্তমান প্রজন্মের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, এমন নয়। কিন্তু দিনটা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক থাকতে পারে, যদি প্রত্যেক নাগরিককে এই দিনে নতুন কোনো লড়াইয়ের দিশা দেখানো যায়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন পুনর্গঠনের পথে, ঠিক তখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক স্বৈরশাসকরা পরাজিত শক্তির শুধু পুনর্বাসন নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও অংশীদার করে। স্বাধীনতার পর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকে। কিন্তু সামরিক জান্তা শাসকরা সে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়। সাজাপ্রাপ্তসহ বিচারাধীনদের কারাগার থেকে মুক্ত করে রাজনীতির চৌহদ্দিতে নিয়ে আসে। শাসকরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতই কেবল নয়, ধামাচাপা দিয়ে রাখে; যাতে পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস ধারণ করতে না পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন নির্বাচনী ওয়াদানুযায়ী। বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে কেঁদে ফেরার পথ রুদ্ধ করে দেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মামলার রায় প্রদান ও শাস্তি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্রের মর্মবাণী হবে গণতন্ত্র। যে রাষ্ট্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মুক্তির আস্বাদ নিয়ে বসবাস করবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদকে প্রতিহত করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওইসব অপশক্তিকে সমূলে উৎখাত করাই এখন লক্ষ্য।
বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছে, কিন্তু খুনির শাস্তি কার্যকর করা যায়নি, কারণ এরা পলাতক ও বিদেশে অবস্থান করছে। বিচার করেও দুজন প্রধান বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীর বিচার একই কারণে নিশ্চিত করা যায়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে এবং সেই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে প্রমাণিত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া খুনিকে ‘শহীদ’ বলছে জামায়াত ও তার মুখপত্র। রাজাকারের তালিকা নিশ্চয়ই আরো দীর্ঘ হবে, পুরো তালিকা দেখতে চায় মানুষ।
তাই এবারের বিজয় দিবস পালিত হোক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ থেকে মুক্তি পাওয়ার শপথে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা