‘সচল’ ঢাকা

মশক নিধনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ‘সুস্থ ঢাকা, সচল ঢাকা, আধুনিক ঢাকা’ গড়ার প্রত্যয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। রোববার সকালে এই ইশতেহার ঘোষণার সময় আতিক বলেন, ‘আমার প্রধান লক্ষ্য আনিস ভাইয়ের কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে কাউন্সিলরদের প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
মশা নিশ্চয়ই এক নম্বর সমস্যা। কিন্তু ঢাকা স্থবির। তাই আতিকুল ইসলামকে বলতে হয়, তিনি ঢাকাকে সচল করবেন। কিন্তু কীভাবে? উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা, দখলমুক্ত ফুটপাত, ব্যক্তিগত গাড়িতে নিয়ন্ত্রণ—এই শহরে কবে হবে সেটা বলা কঠিন। কিন্তু মানুষ শহরে চলতে চায়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে চায়।
সরকারি চাকরি যাঁরা করেন, তাঁদের জন্য সরকারি গাড়ি আছে, অফিসে দেরিতে গেলেও চাকরি যাওয়ার সমস্যা নেই। কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে ছুটে চলতে হয়, তাঁদের কাছে গতিই জীবন। কিন্তু সেই গতি নেই এই শহরে।
ঢাকা এখন শুধু মানুষের নগরী। লাখ লাখ মানুষে ঢাকা শহর গিজগিজ করছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) বলছে, এই শহরে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস। এক বর্গকিলোমিটার জায়গায় ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ বাস করে। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন নতুন করে দুই হাজার ১৩৬ জন ঢুকে পড়ছে এই শহরে। আর বছর শেষে যুক্ত হচ্ছে সাত লাখ ৮০ হাজার নতুন মানুষ। এমন হারে মানুষ বাড়লে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাগরিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব? পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যানজটের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
সম্ভব না, কিন্তু তবুও মেয়র হতে হলে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এমন শহরকে সচল করার তরিকা কী, সেটা খুব বিস্তারিত বলেননি আতিকুল ইসলাম। রাস্তায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। শহরের প্রায় সব ফুটপাতই দখল হয়ে আছে, ফলে মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য। কাজেই রাস্তার মাপ আরো কমেছে। এই শহরের নামেমাত্র রাস্তায় বহু গাড়ি একটু জায়গার জন্য আক্ষরিক অর্থেই মারামারি করছে। শহরের ট্রাফিক শ্লথ, বললে কিছুই বলা হয় না। শ্লথেরও শ্লথ। এ অবস্থাতেই শহরকে সচল করার কথা বললেন আতিকুল।
একটা উপায় হতে পারে, যদি প্রায় সব সড়কে আলাদা সাইকেল লেন করা যায়। গোটা দুনিয়া সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব পরিবহনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এই শহরের অবস্থাটা হলো, সবাই নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে যেতে চান। যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা বেশি গুরুত্ব দেন তাঁদের; যাঁরা নিজেদের গাড়িতে চড়েন। এখানে পরিবহনকেন্দ্রিক সব ভাবনা। গণপরিবহন বাড়াও বা বাড়াতে হবে এটা রাজনীতিক, আমলা বা নীতিনির্ধারকরা বলেন ঠিকই, কিন্তু মন থেকে বলেন না।
হয়তো অনেক উন্নত দেশের মতো, ঢাকায় কোনো একদিন নিয়ম হবে যে, শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঢুকতে চাইলে বিশেষ ছাড়পত্র লাগবে এবং সেটা কিনতে অনেক টাকা কর দিতে হবে। শহরে গাড়ি পার্কিংয়ের খরচও বিপুল পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে ততদিনে এই শহর আরো অচল হবে নিশ্চয়ই। গণপরিবহনের গুরুত্ব দিতে গেলে বাসগুলোকে চড়ার মতো করতে হবে। আর মন্ত্রী-সচিবরা যদি কষ্ট করে গাড়ির বদলে একটু বাসে যাতায়াত করতেন বা সাইকেল চালাতেন, তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে অনেকেই তাঁদের পথ ধরতেন। একজন মানুষের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি যতখানি রাস্তা দখল করে, বাস সে তুলনায় কিছুই করে না। গাড়ির বদলে অনেকে যদি বাসে চড়তেন, তা হলেই সাইকেলের জন্য যথেষ্ট রাস্তা পাওয়া যেত। দুনিয়ার বহু সভ্য শহরে এটাই হয়। কিন্তু আমরা সভ্য হতে পারছি না।
যে বাসগুলো চলে, তাঁদের মালিক ও শ্রমিকদের আচরণ এত মারমুখী যে নিরীহ লোকজন, নারী এসবে চড়তে ভরসা পান না। কিছু পরিচিত পরিবহন শ্রমিক নেতা ও মালিক নেতা গরিব পরিবহন শ্রমিকদের দোহাই দিয়ে এই খাতে কোনো শৃঙ্খলা আনার পক্ষে নন। ফলে এখানে মানুষ উপযোগী বাসপ্রথা আজও বের হলো না। এই শহরেই যদি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভালো বাস চালু করা যায়, অনেকেই নিজ গাড়ি ছেড়ে সেসবে চড়বেন। কিন্তু পরিবহন খাতের শ্রমিক ও মালিক নেতাদের মর্জিমাফিক পরিবহন ব্যবস্থায় অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের।
আমাদের কপালের লিখন—গাড়ির চাপে অনড় ঢাকা। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে তেল-গ্যাস পোড়ায় গাড়িগুলো। সেই দূষণ বাতাসে ভাসে। বায়ু দূষিত হয় উন্নয়নযজ্ঞে। ঢাকায় কিছু ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে। আরো হচ্ছে। কিন্তু শহর সচল হচ্ছে না। শহরের রাস্তা খালি করার জন্য ফুটপাত খালি না করলেই নয়। কিন্তু ফুটপাত দখলে রেখেছে হকারদের। এঁদের সরাতে গেলেই রব উঠবে, এঁরা দরিদ্র মানুষ। হকাররা ফুটপাতে আছেন। আবার রাস্তার পাশের দোকানের শোরুম এখন ফুটপাতে নেমে এসেছে। ফুটপাতের অধিকার এভাবে হকার আর দোকানদারদের হাতে ছেড়ে দিলে শহরটাই বা যাবে কোথায়?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা