শুভ নববর্ষ ১৪২৪
ঔদার্যে ভরে উঠুক নববর্ষের দিন
মহাকালের পথ পরিক্রমায় আরেকটি বর্ষ গত হয়ে আবার এক নতুন প্রভাতসূর্যের স্বর্ণালি আভায় সেজে উঠল হাজার বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত আমাদের স্বদেশভূমি। পুরনো কথা, বিয়োগ ব্যথা আর যতসব গ্লানি ভুলে যাকিছু প্রাপ্তি তাকে সঙ্গে করে এগিয়ে চলার মন্ত্রণা হোক আজ নতুন দিনের দীপ্ত আবাহন। প্রাণে প্রাণে বাজুক অপর মানুষের মহানুভব ভালোবাসা। সত্য ও সুন্দরকে মাখামাখি করে কল্যাণময় হোক আপামর মানুষের জীবন। শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪২৪।
প্রচলিত বাংলা সনের সুত্রপাত মোগল আমলে। তার আগে এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। সম্রাট আকবর তাঁর নিজের সিংহাসনে আরোহনের কাল, পুরোনো বাংলা দিনপঞ্জির সৌরসন, হিজরি চান্দ্র সন এবং খ্রিস্টীয় সাল মিলিয়ে তারিখ-ই-ইলাহী ঘোষণা করেন। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হলেও পরে তা বঙ্গাব্দে রূপ লাভ করে।
আকবর অভেদ মানুষের মহাসম্মীলনের কথা ভেবেই হয়তো এমনটা করেছিলেন। মুসলমানরা বাংলা সনকে বলবে হিন্দুয়ানী আর হিন্দুরা ইংরেজি সনকে বলবে খ্রিস্টীয় এমন জাতি ধর্ম বর্ণের বিদ্বেষ তারিখ-ই-ইলাহী প্রণেতাদের মধ্যে নিশ্চয় ছিল না। এখনকার দিনে যদি ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করবার কথা বলা হয়, তবে বাঙালিয়ানার স্বতঃসিদ্ধ চেতনা ধারণ করা ছাড়া অন্য উপায় ফলপ্রসূ হবে না। সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি আর হালের হিন্দির সঙ্গে লড়ে লড়েই বাংলার আজকের অবস্থান। সেই বাংলাকে, বৈশাখকে, নববর্ষকে ধর্মের মোড়কে বসিয়ে দিয়ে বর্জনের আহ্বান এক ধরনের অর্বাচীন বাতুলতা। সবার মনে রাখা জরুরি, আগে বাঙালি, তারপর মুসলমানত্ব। আর সবার ওপরে হলো মনুষ্যত্ব। মনুষত্ব মানুষকে বিদ্বেষ শেখায় না, শেখায়, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, মমত্ববোধ ও ভালোবাসা।
জীবনক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই ৫২ বা ৭১-এর গৌরবময় ইতিহাস বিনির্মাণ করেছি আমরা বাংলাভূমির সন্তানরা। ইতিহাসের নানা বাঁকবদলে মানবিক অধিকার আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বারবার, হিন্দু বা মুসলমানের জাতিবোধ নয়। তেমনি আমাদের বাঙালিয়ানা, পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসবটাও আমাদের মানবীয় মিলিত আয়োজন। কোনো একক ধর্ম বা গোত্রবোধ এখানে মূখ্য হতেই পারে না।
আকবরে সময়কালে বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরের দিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
আর আজকের দিনে সেই শুভদিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে শুধু পালিতই হচ্ছে না, প্রজাতন্ত্রের কর্মীদেরকে রাষ্ট্রীয় ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে লোকজ অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দিয়ে প্রথমবারের মতো বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন দেশ উৎসব। গত বছর ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিলে তা আরো ভিন্নতর মাত্রা পায়। আজ সারা দেশের সব সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/শিক্ষার্থীরা আনন্দ শোভাযাত্রার মাধ্যমে একে অপরের মঙ্গল কামনা করছে। বিভিন্ন স্থানে মেলা উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালির পূর্ব ইতিহাস স্মরণ করছে। আর পরিবার, স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মেতে ওঠছে আনন্দ হৈহুল্লোড়ে।
বরাবরের মতো এবারও চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রঙ-তুলির নানা কারুকার্যে লোকজ উপাদানগুলোকে সরাচিত্র, মুখোশ আর নানা অনুষঙ্গে ফুটিয়ে তোলে মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল আয়োজন সাজিয়েছে। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে সামনে রেখে এবারের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’।
নববর্ষ এলেই সমস্বরে উচ্চারণ করা হয়, ফেলে আসা বছরের জরাজীর্ণতা আর পঙ্কিলতাকে মুছে দিয়ে ঐক্য ও সৌহার্দ্যের বার্তা ছড়িয়ে যাবে সব প্রাণে। অসাম্প্রদায়িক বন্ধনটা আরো বেগবান হবে। কেন!
তবু সর্বজনের প্রাণবন্ত উৎসব হয়ে ওঠুক বাংলা নববর্ষ। ঘরে বানানো হোক বাহারি পিঠা ও খাঁটি গুঁড়ের মিষ্টান্ন। সুস্বাস্থ্যের জন্য পাহাড়ি আদিবাসীদের ‘পাজন’-এর আদলে নানারকম সবজির সমন্বয়ে উনুনে ধূমায়িত হোক নিরামিষের সুঘ্রাণ। কোনো একদিনের পান্তাভাতের ঢং বা অকালে ইলিশ খাওয়ার ধুমের চেয়ে ইলিশ রক্ষার চেতনাটা জাগরুক রাখাটা হোক স্বতঃস্ফূর্ত অভিলাষ।
আমরা চাই উজ্জীবনী উৎসবে সবার অংশগ্রহণে হোক সর্বব্যাপী শোভাযাত্রা। বাঙালির লোকায়ত শেকড় সন্ধানের পাশাপাশি সর্ব ধর্মবোধের সত্য সরলরেখায় যদি শোভাযাত্রা সেজে ওঠে তবে তা হতে পারে উৎকৃষ্ট ঔদার্যিক অসাম্প্রদায়িকতা। তা হবে সত্যিকার অর্থে মানবীয় যুথবদ্ধতা। নতুনকে আলিঙ্গনের পরিপূর্ণ উৎসব। যে উৎসবের আনন্দে মেতে আমরা হয়ে ওঠব আগামীর লড়াইয়ে টিকে থাকবার প্রকৃষ্ট মানুষ। আজ নতুন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে বছরের প্রথম যে দিনটি শুরু হলো সেইদিনে এই হোক আমাদের রাবীন্দ্রিক প্রার্থনা :
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সঙ্গে
পুরাতন অপরাধ যত।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন