ব্যবসায় সহজতা

গত সপ্তাহে ফেনীর আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার রায় হওয়ায় গণমাধ্যমে আরো একটি উল্লেখযোগ্য খবর তেমন জায়গা পায়নি বা মানুষের দৃষ্টি কাড়তে পারেনি। বিশ্ব ব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) সূচকের মাপকাঠিতে আট ধাপ এগিয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম স্থানে এলো বাংলাদেশ। নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য লাল ফিতের ফাঁস কাটানোয় কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা জানা না গেলেও এই খবর দেশের জন্য অবশ্যই সুখবর।
বাংলাদেশের মতো দেশে ব্যবসা শুরু করা আর সেটা নির্বিঘ্নে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা সহজ নয়। দ্রুতগতিতে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত স্তরে পা রাখতে চায় দেশ। এ জন্য দরকার দেশে ব্যাপক হারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আছে তাদের উৎসাহ দেওয়া। ঠিক এ বিষয়ে সুযোগ ও সামর্থ্য বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান খুব সুবিধার নয়। তবে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজ করার সূচকে এই আট ধাপ অগ্রগতি আশার আলো সঞ্চার করে।
এর আগে গত মাসে ব্যবসা সহজ করার সূচকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করা ২০টি দেশের নাম প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক দাতা সংস্থাটি। সেখানেও জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর এবার ৪৫, যা গত বছর ছিল ৪১ দশমিক ৯৭।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের সময়টায় সারা দেশেই মানুষের মনে একটা উন্নয়ন স্পৃহা লক্ষ্যণীয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সারা বিশ্বেই আলোচিত। কিন্তু তবুও ব্যক্তিখাত যে খুব বড় উল্লাসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তা বলা যাবে না। শিল্প স্থাপন বা যেকোনো নতুন উদ্যেগ নিয়ে আলোচনামাত্রেই একটা প্রশ্নের সামনে এসে হোঁচট খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা আর তা হচ্ছে জমি। জমি পাওয়া, তার মূল্য ঠিক করা এবং অধিগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত ব্যবসা শুরু করা এক কঠিন কাজ। উদ্যোক্তারা জমির প্রশ্নটি তুললে সরকারের তরফ থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হতো ঠিকই, বলা হতো শিল্প গড়তে চাইলে জমি নিয়ে সমস্যা হবে না।
কিন্তু জমির সমস্যা আছে। শিল্পায়নের উপযোগী যথেষ্ট জমি কি দেশে আছে? এই প্রশ্নটার কোনো সহজ উত্তর নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত একটি বড় প্রচেষ্টা হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশজুড়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গে পার্টনারশিপে বেশ কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন প্রায় তৈরি এবং সেগুলোতে দেশি বিদেশি বিনিয়োগও আসা শুরু হয়েছে। শিল্পের জন্য বিভিন্ন দক্ষতার শ্রমিক প্রয়োজন। বহু সংখ্যক শ্রমিক একই জায়গায় পাওয়া যাবে, বিনিয়োগকারীরা এমন জায়গাই খোঁজেন। কারণটা বোঝা সহজ প্রয়োজন পড়লে যাতে যথেষ্ট শ্রমিক কম সময়ের মধ্যে পাওয়া সম্ভব হয়। এই কারণেই কোনো একটি বিশেষ জায়গার প্রয়োজন। দুই ভাবে শিল্পায়ন সম্ভব - এক, শিল্পকে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে; দুই, গ্রামের মানুষকে শহরের কাছাকাছি শিল্পক্ষেত্রে কাজ দিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দুটো উদ্দেশ্যকেই সফল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এই নতুন সূচক থেকে এটা বোঝা গেল যে, বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। অবকাঠামো খাতে ব্যাপক অগ্রগতি, বিশেষ করে বিদ্যুৎ-সংযোগ সহজ হওয়া এ ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে। আর্থিক খাতে সমস্যা থাকলেও ঋণপ্রাপ্তির দিক থেকেও বাধা কমেছে। দেশে নতুন কোম্পানি নিবন্ধনে খরচ কমেছে। ডিজিটাল সনদ পেতে কোনো ফি দিতে হচ্ছে না। শেয়ার ক্যাপিটালের ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন ফিও কমানো হয়েছে।
এক বছরে ব্যবসার সূচকে আট ধাপ এগোনো দুনিয়ার যে কোনো দেশের জন্য বড় অগ্রগতি। তবে এতে আত্মপ্রসাদে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ, বিশ্বপরিসরে ১৯০টি দেশের মধ্যে এখনো আমাদের অবস্থান ১৬৮তম। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তান বাদে অন্যরা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। ফলে এ ক্ষেত্রে বিশ্বমান দূরের কথা, দক্ষিণ এশীয় মান অর্জন করতে হলেও আরো এগোতে হবে।
অর্থনৈতিক খাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রম চলছে। এখানে গতি আনতে হবে। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করতে অনেক সময় চলে যায়। এই সূচকে অগ্রগতির অনেক সুযোগ রয়েছে। সম্পত্তি নিবন্ধনেও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। এখানেও অনেক সংস্কার আনতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য সূচকে ভালো করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমে গতি আনার কোনো বিকল্প নেই যদি সামনের বছর আরো ভালো করতে চাই।
অর্থনীতির মেরুদণ্ড হল মাঝারি উদ্যোগ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই মাঝারি শিল্প হলো বৃহৎ শিল্পের অনুসারী। ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প স্বয়ম্ভূ নয় যে, মরুভূমির মধ্যে ক্যাকটাসের মতো গজিয়ে উঠবে। শিল্পের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে বৃহৎ শিল্পের বিনিয়োগ আসে। বাংলাদেশে একটি পুরোনো শক্ত উদ্যোক্তা শেণি আছে। কিন্তু প্রয়োজন নতুন উদ্যোক্তার। প্রয়োজন নবীন উদ্যোক্তা শ্রেণি যাদের উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার দ্বারা ব্যবসায়িক মডেলের নব প্রবর্তন হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন আর আমলাতন্ত্রের আরো বেশি প্রাইভেট সেক্টর বান্ধব হওয়া জরুরি।
ব্যবসা বাণিজ্যে আরো বড় একটি আলোড়ন দরকার। আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান দরকার। সবাই বলে সুদিনের বীজ আছে আমাদের যুবশক্তির মধ্যে। আমরা নাকি অচিরেই ডেমোগ্রাফিক লভ্যাংশ পাব, এটাই আমাদের স্বপ্ন। কিন্তু যদি এই যুবশক্তি চাকরি বা জীবিকা না পায়, তবে সে স্বপ্ন পরিণতি হবে দুঃস্বপ্নে। পুঁজিবাজারের দিকেও সরকারের নজরটা প্রয়োজন। যদি দ্রুত বিনিয়োগ না আসে, যদি ব্যাপক শিল্পায়ন না হয়, যদি অবকাঠামো খাতের সম্প্রসারণ কাজগুলো দ্রুত শেষ না হয়, তবে থাকবে হতাশা এবং বেকারত্বের জ্বালা। সেই হতাশা থাকলে চলবে চাঁদাবাজি গুণ্ডামি আর সিন্ডিকেটের নানা কর্মকাণ্ড।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।