সালমান, মায়ের ছেলে বিগড়ে গেছে : শোভা দে
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/11/photo-1431353281.jpg)
শোভা দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ও কলামিস্ট। জনসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। সালমান খানের চলমান মামলার প্রেক্ষাপটে একটি ভিন্ন কিন্তু জরুরি বিষয় যাচাই করেছেন তিনি। শোভা দের এই লেখা প্রকাশিত হয়েছে গতকাল রোববার ১০ মে এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে।
বাল্টিমোরের রায়টে আমরা পেয়েছিলাম এক ভিন্ন নায়িকাকে। এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মা। ডানপিটে ছেলেকে ধাওয়া করে রীতিমতো সবার সামনে পিটিয়ে ঘরে ফেরত এনেছিলেন। তা সেই ছোঁকরা মাকে এমন চটিয়ে তোলার মতো কী কাজ করেছিল আসলে? বেশি কিছু নয়, কিছু পাথর জোগাড় করে পুলিশের দিকে ছোড়ার পাঁয়তারা করছিল, পুলিশ তখন খ্যাপা জনতার ভিড় আর ডাকাতি সামলানোর চেষ্টায় হাঁসফাঁস। এই ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে রাতারাতি, আর সেই মা খেতাব পেয়ে গেছেন ‘মাদার অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে। তাঁর প্রাপ্তি আসলে কী ছিল? প্রকৃতপক্ষে...তিনি দুনিয়াজোড়া পরিচয় পেয়েছেন সঠিক কাজটি করার জন্য; ছেলেকে শোধরানোর সঠিক পদক্ষেপটি নেওয়ার জন্য...এবং সম্ভবত ছেলের জীবন বাঁচানোর জন্য।
দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মা এই নারীকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কারণ তিনি সেই কাজটি করেছেন যা অনেকেই নিজের ছেলের ক্ষেত্রে করার সাহস পান না, তাঁদের শৃংখলার মধ্যে রাখা।
সারা দুনিয়া মা দিবসকে স্মরণ করেছে বিভিন্নভাবে। এখনই সম্ভবত একটি প্রশ্ন করার সঠিক সময়। সন্তানের ক্ষেত্রে যখন সেই মোক্ষম সময়টি চলে আসছে, তখন কি তারা ‘দরকারি সঠিক কাজ’টুকু করছেন?
সালমান এ রোববারটা কীভাবে কাটিয়েছেন, তা জানতে পারলে মজা হতো। ছেলের চলমান মামলার কারণে ভীষণ মানসিক চাপে ভুগছিলেন সালমানের মা সালমা খান, এ জন্য অসুস্থও হয়ে পড়েছেন খবর মতে। আসলেই দারুণ ভাগ্য তাঁর, কারণ তাঁর আশপাশে বিশাল এক পরিবার- আর সেই সাথে সুহৃদ আর সমর্থকদের বিশাল বলয়।
যেকোন বিপদ আপদের সময় বলিউড চটজলদি বহুকিছু ধামাচাপা দিয়ে নিজেদের মানুষটিকে বাঁচায়। তবে ব্যাপারটা আসলে কী, ভাতৃত্বের এই শক্তিশালী বন্ধন আর এগিয়ে আসার যে মাত্রাটা দেখা গেল—এমনটি সালমানের চেয়ে নিচুসারির কোনো তারকার ক্ষেত্রে ঘটত কি না, তাতে কিন্তু সংশয় রয়েছে!
শোবিজ এভাবেই কাজ করে- বিশেষ করে এমন কোনো অভিনেতা যার ওপর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ বিনিয়োগ করা হয় বা হয়ে রয়েছে, তাঁর ক্ষেত্রে তো বটেই। বলিউডের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় একটি বিষয় সবচেয়ে তেড়েফুঁড়ে উঠে এসেছে- ২০০ কোটি বা আরো বিনিয়োগ সালমানের ওপর। ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ভিকটিমদের পরিবার নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা দেখা যায়নি। তাদের আচরণটা আসলে কী বা কোন খাতে এগোচ্ছে, তা ওই সব মানুষের প্রতি তাদের ঔদাসীন্য বা অজ্ঞতাই স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়।
এখানেই সালমা খান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সন্তানকে শোধরানোর চেষ্টা করার ক্ষেত্রে সময় কোনো ব্যাপার না। যেকোনো সময়ে মা সন্তানকে শেখাতেই পারেন। সালমানের বয়স ৫০ হতে পারে কিন্তু এখনো তো তিনি সালমার কাছে ছোট্ট ছেলেটিই। সালমা বড়ই ভালোবাসেন ছেলেকে। সালমানও মাতৃ অন্তঃপ্রাণ। বেশ ভালো কথা। এখন সালমার সময় এসেছে নিজেকে কিছু দরকারি প্রশ্ন করার। সেই ছেলেটিকে বড় করে তোলার সময়, যে কি না আজ বলিউডের বেশুমার পয়সাওয়ালা এক তারকা-ঠিক কখন পা হড়কে গিয়েছিল তাঁর? পরিণত বয়সের অধিকাংশ সময়েই একের পর এক বিপদ আপদ আর ভুল কাজে জড়িয়েছেন সালমান। তাঁর কিছু ভালো কাজ আর দানশীলতাকে উদ্দেশ্য করে সাফাই গাওয়াটা ভুল হয়ে যাচ্ছে, কারণ বিভিন্ন কুকর্মে তাঁর কয়েক দশক ধরে গড়ে তোলা দারুণ ক্যারিয়ার বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। এখনো পর্যন্ত তাঁর জীবনে কোনো চিরস্থায়ী ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বা সোজা কথায় এখনো কোনো শাস্তি পাননি তিনি, এ নেহাত কপালজোরে। তাঁর ক্যারিয়ারের ঘোড়দৌড় ছিল, বলা যায় মোটামুটি স্বপ্নের মতো। তবে সেটা ভবিষ্যতে বদলাতেই পারে।
অধিকাংশ ভারতীয় মায়েরাই তাঁদের মহামূল্য ছেলেটির জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন ভালোবাসা দেখান। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বিষয়টি এমন, সব সময়ই এমন ছিল এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও আসলে এমনই থাকবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মায়ের কাছে এই মামা’স বয়দের সাত খুন মাফ, আর এটা নির্লজ্জভাবে বলতে একটুও বাধে না। এ মুলুকের মায়েরা মেয়ে আর ছেলের মাঝে তফাত টানেন তীব্রভাবে এবং তাঁরা যেমন পুরুষানুক্রমিক ব্যবস্থায় বড় হয়েছেন, সে রকমভাবেই তাঁদের ছেলেদের জন্য আগ বাড়িয়ে ভালোবাসা দেখান নির্লজ্জভাবে। এই ‘ফেভারিটিজম’-টাকে সমাজও দারুণ হাততালি দেয়, বাহবা জোগায়। সুতরাং ছেলেরা বেড়ে উঠতে থাকে সেলফ-ইম্পরট্যান্সের এক বাড়াবাড়ি রকমের অনুভূতিসমেত।
পরিবারের বিশেষ অবস্থা বারবার টের পাওয়া যায়। এরপর একপর্যায়ে তাঁরা নিজেদের দেবতার অবতার মনে করতে শুরু করেন, যাঁরা আসলে কোনো পাপই করতে পারেন না (পড়ুন যাঁদের কোনোকিছুই আসলে অপরাধ নয়!)
সালমানের এই ইমোশনাল গ্রাফ আর এবড়োথেবড়ো কাজকর্মের রেকর্ডই বলে দেয়, তিনি সবকিছু পেয়ে পেয়েই বড় হয়ে উঠেছেন। কখনো ‘না’ শোনেননি, তাঁকে শুনতেও হয়নি। রুপালি পর্দাতেও তরুণ বয়স থেকে বিস্তর সুবিধা পেয়েছেন। সুতরাং তারকা হয়ে ওঠার পর কোনো দায়িত্ব বা ভাবমূর্তি বহন করতে হয়, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণাও তাঁর কখনোই ছিল না- কি তাঁর কাছে, কি তাঁর পরিবারের কাছে।
মা হয়ে ওঠাটা কষ্টকর। প্যারেন্টাল গাইডেন্স এমন একটা জিনিস যেটা কাউকে বলেকয়ে শেখানো মুশকিল, দুঃসাধ্যই বলা যায়। ‘নাজুক’ সন্তানকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করাই মায়ের প্রবৃত্তি হিসেবে কাজ করে। সালমা তা-ই করেছেন। কিন্তু একটি সন্তানকে কেন এভাবে গড়ে তোলা? মায়েরা কেন সন্তানকে শোধরাতে অস্বস্তি বোধ করেন, বিশেষ করে ছেলেসন্তানের ক্ষেত্রে? শিশুকে প্রকৃত মূল্যবোধ শেখান কে? একজন মায়ের ভালোবাসা কি এতটাই অন্ধ হওয়ার দরকার আছে যে সন্তান বিপথে চলে যাওয়ার পরেও তিনি শোধরানোর জন্য কিছু করবেন না, বলবেন না বা প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না?
কিছু প্রেক্ষাপটে, সালমান আদতে বড়ই হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর আসলে দরকার পড়েনি। তাঁর জীবন একেবারেই ‘সেট’ হয়ে ছিল।
দুর্ভাগ্যবশত, এখন এমন কিছু প্রশ্ন উঠেছে যেগুলোর উত্তর দিতে হবে। এই মামলা যেদিকেই গড়াক বা যে গতিতেই এগোক, কিছু মানুষজন রয়ে যাবেন যাঁরা কখনোই সালমানকে মাফ করতে পারবেন না, করবেন না। তাঁরা কখনোই সেই আহতদের বা মৃত মানুষটির শোক ভুলতে পারবেন না। এটা হলো সমব্যথিতা। মানুষ হয়ে ওঠার জন্য সমব্যথিতা আবশ্যক। একজন মানুষের এবং প্রতিটি মানুষের জন্য।
আমি আশা রাখি, এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি নিয়ে সালমা খান তাঁর আদরের সন্তানের সাথে ঠিকঠাক আলাপ করবেন।
এতে করে ভারতের আরো অনেক মায়ের বিগড়ে যাওয়া খোকাবাবুরা একেবারে উচ্ছন্নে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে।