জাতিসংঘ দিবস
ব্যর্থতা-সফলতার ৭১ বছর

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থার নাম জাতিসংঘ। বিশ্বের সব স্বাধীন দেশের সংস্থা এটি। ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ১৯৪৫ সালে এ দিনটিতে একটি চার্টারের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে এক চুক্তির মাধ্যমে জাতিপুঞ্জ বা ‘লিগ অব নেশনস’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইতিহাসে সেই চুক্তিটি ‘ভার্সাই চুক্তি’ নামে পরিচিত। তখন এ সংস্থা গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে। তাই সে বিষয়ে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করল জাতিপুঞ্জ। সেই ভাবনার অংশ হিসেবে জাতিপুঞ্জ বা লিগ অব নেশনসই ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে এক সম্মেলনের মাধ্যমে লিগ অব নেশনস থেকে জাতিসংঘে রূপান্তরিত করা হয়, যার চার্টার ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ সালে গৃহীত হয়েছিল।
যেহেতু ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস, সে জন্য জাতিসংঘ সদর দপ্তর কর্তৃক প্রতিবছর ২০-২৬ অক্টোবর জাতিসংঘ সপ্তাহ পালন করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘ দিবসের সঙ্গে ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইনফরমেশন ডে’ নামে আরেকটি দিবস পালন করা হয়ে থাকে, যা ১৯৭২ সাল থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সাল থেকে ২৪ অক্টোবরকে বিশ্বের জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোয় জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। জাতিসংঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে ছয়টি পরিষদ রয়েছে, যথা—সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, অছি পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয় ও সচিবালয়। তবে এগুলোর মধ্যে সাধারণ পরিষদ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ব্যাপ্তিই সবচেয়ে বেশি। যেকোনো বিষয় সাধারণ পরিষদে আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সে জন্য জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রই সাধারণ পরিষদের সদস্য।
প্রতিবছরই কমপক্ষে একবার সাধারণ পরিষদের মিটিং হয়ে থাকে এবং সেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের জন্য কল্যাণকর অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তখন জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিশ্বের বিভিন্ন সদস্য দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরাজমান অনেক সমস্যার সমাধান করতে প্রয়াস পান। তারপর বিশ্ব নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। নিরাপত্তা পরিষদের মোট সদস্য রাষ্ট্র ১৫টি। বাদবাকি ১০টি হলো অস্থায়ী সদস্য। অস্থায়ী সদস্য দেশগুলো দুই বছর মেয়াদে বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে থাকে।
নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি শক্তিশালী ও স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হলো—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন। বিশ্বের কোনো দেশে শান্তি বিরাজ করবে নাকি অশান্তি থাকবে, তা অনেকটা নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত রীতি অনুযায়ী যেকোনো একটি ফোরাম কিংবা মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত হয় সেই ফোরামের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাধিক্যের ভিত্তিতে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আরেকটি অদ্ভুত ও বিতর্কিত বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। আর সেটি হলো পাঁচটি স্থানীয় সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা। অর্থাৎ কোনো একটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে যতই সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত থাকুক না কেন, সেখানে যদি ১৫টি সদস্যের মধ্যে ১৪টি সদস্য রাষ্ট্রও একদিকে ভোট দেয় আর স্থায়ী মাত্র একটি দেশও সেখানে অন্যদিকে ভোট প্রদান করে, কিংবা ভোটদান থেকে বিরত থাকে, তবে সে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হবে না। ইতিহাসে একেই ভেটো ক্ষমতাবলে আখ্যায়িত করা হয়।
আন্তর্জাতিক বিশ্লষকদের ধারণা, এ ভেটো ক্ষমতার জন্যই বিশ্বের অনেক সমস্যার সহজ সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। আবার সেটির একটি ভালো দিকও যে রয়েছে, তা-ও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এ রকম না থাকলে আবার দেখা যেত শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর দেশ দু-একটি মিলে নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভোটদান করছে। তাতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়তো আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত। এখন অন্তত শক্তিধর দেশগুলো একটি আরেকটির কাছে পুরোপুরি আটকা রয়েছে। একেই বলে শক্তির ভারসাম্যতা বা ব্যালান্স অব পাওয়ার। কোনো কাজ করতে চাইলে সবাইকে রাজি করেই করতে হবে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কয়েকটি বিশেষায়িত সংগঠন রয়েছে, এগুলো হলো—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো), জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর), জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচআরসি) ইত্যাদি।
তা ছাড়া জাতিসংঘের আওতাধীনে থেকেই কাজ করছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) ইত্যাদি আরো অনেক সংগঠন। এবারে জাতিসংঘ দিবস পালন উপলক্ষে সেখানে যে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে তার থিম হলো ‘ফ্রিডম ফার্স্ট’। আগেই বলেছি, এ বছর পালন করা হচ্ছে জাতিসংঘের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিসংঘ অনেক দূর এগিয়েছে। গত ৭০ বছরে এর অনেক বিফলতাও যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে সফলতাও। তবে একবাক্যে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, বিফলতার চেয়ে সফলতাই বেশি। বিফলতার সবচেয়ে বড় জায়গাটি হলো এর ভেটো ক্ষমতা। অন্যদিকে এখন এককেন্দ্রিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য। সেখানে আর্থিক নিয়ন্ত্রণও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অনেকটা। সেই যুক্তরাষ্ট্রই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জাতিসংঘকে। কাজেই একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে ভেটো ক্ষমতা, সে জন্য জাতিসংঘের প্রতিটি কাজকর্মে দিনশেষে যুক্তরাষ্ট্রেরই নীতির প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। সে জন্য জাতিসংঘ ইসরায়েল-ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিষয়ে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তবে সরাসরি এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে না পারলেও পরোক্ষভাবে অনেক কাজ করছে সেখানে। যেমন প্রতিবছরের সাধারণ পরিষদের মিটিংয়ের সময় বিশ্বের যেসব শীর্ষ নেতা জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সমবেত হন, সেখানে সাধারণ পরিষদের আলোচনার বাইরেও অনেক দেশ দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের অনেক সমস্যা সমাধানের প্রয়াস পেতে দেখা যায়। অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় স্থানে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণাধীনে শান্তিরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে সেখানে দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিকদের সেবাপ্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে। বাংলাদেশ এসব শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে একটি সম্মানজনক স্থান করে নিয়েছে।
জাতিসংঘ দিবস পালনের জন্য এবারে ২০১৫ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত মেয়াদে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আর সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। কারণ, জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ২০০০-২০১৫ মেয়াদে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতে (এমডিজি) সাফল্য দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া জাতিসংঘের নিয়মিত চাঁদা প্রদান থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজেই বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কৃতিত্বের দাবিদার। সে জন্য জাতিসংঘও বাংলাদেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা একমাত্র শেখ হাসিনাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে চলেছেন এবং জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্থান দেওয়ার জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাতিসংঘের একজন প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান থাকলেও সচিবালয়ের সার্বিক কাজের দায়িত্ব থাকে মহাসচিবের ওপর। প্রতি পাঁচ বছরের জন্য একজন স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিককে সংস্থাটির মহাসচিব হিসেবে সাধারণ পরিষদে নির্বাচিত করা হয়। সেখানে একটি অলিখিত বিধান রয়েছে এমন যে, একেকজন মহাসচিব পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সংস্থাটির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এটিই অনুশীলন হয়ে আসছে। বর্তমানে সর্বশেষ যিনি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন, বান কি মুনের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। মহাসচিবের পদে নির্বাচনের জন্য মেয়াদ শেষ হওয়ার বেশ আগে থেকেই সে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে নির্বাচিত হয়ে থকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বান কি মুনের দ্বিতীয়বারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে। সে জন্য ১৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখেই এর মহাসচিব নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য মহাসচিব ঠিক করে রাখা হয়েছে।
আগামী ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি নতুন মহাসচিব হিসেবে যোগদান করবেন পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টিনিও গুতেরেস। তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তা ছাড়া তিনি এর আগে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘেরই শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করেছেন। রাজনীতি ও কূটনীতিতে অভিজ্ঞ এ ব্যক্তি মহাসচিব হিসেবে তাঁর কাজে সফল হবেন, এটাই বিশ্ববাসী প্রত্যাশা করে। তবে এখন বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক শক্তিকেও বড় হিসেবে দেখা হয়। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে আরো কার্যকর রাখার জন্য বিদ্যমান ভেটো ক্ষমতা উঠিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু সেটি করা কঠিন হলেও অন্তত সেখানে স্থায়ী সদস্যসংখ্যা আরো বাড়িয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিযোগিতার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করা প্রয়োজন। তাহলেই জাতিসংঘের সফলতার পাল্লা আরো ভারী হবে বলেই মনে করেন অনেকে। জাতিসংঘ দিবসে তাই বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে সেটাই সকলের কাছে প্রত্যাশিত।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।