কপ-২২ সম্মেলন
স্বল্পোন্নত দেশের নেতৃত্বে বাংলাদেশ
বিশ্ব জলবায়ু বিষয়ে সর্বোচ্চ ফোরাম কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ—সিওপি (কপ-২২) সম্মেলন শুরু হয়েছে ৭ নভেম্বর থেকে। আফ্রিকার দেশ মরক্কোর রাজকীয় পর্যটন ও অবকাশকালীন শহর মারাকেশে ১২ দিনব্যাপী এ গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন চলবে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। তার মধ্যে ৭ থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত চলেছে সংস্থাটির টেকনিক্যাল পর্যায়ের বিভিন্ন সেগমেন্টভিত্তিক আলোচনা, সেমিনার, বক্তৃতা, সেশন ইত্যাদি। ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত চলছে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী হাই লেভেল সেগমেন্ট। সেখানে বাংলাদেশের ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রতিনিধিদলে আরো রয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবসহ সশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা। তার আগে ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি অগ্রবর্তী প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছে। এ বছরের সম্মেলনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গত বছর ৩০ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়।
সেই সম্মেলনে বিশ্ব পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্তটি ছিল ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস বিষয়ে। বিশ্বের প্রায় ২০০টির মতো দেশ একমত হয়ে প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পবিপ্লব পূর্ব সময়ের তুলনায় দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এবং সেখানে আরো সিদ্ধান্ত হয়, তা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়। তদানুযায়ী ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিলের মধ্যে ওই বাধ্যবাধকতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হলে ৪ নভেম্বর থেকে চুক্তিটি বাস্তবায়নে যাওয়ার কথা। বাংলাদেশ জলবায়ুর বিষয়ে উদ্যোগী দেশগুলোর অন্যতম হওয়ায় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই (২২ এপ্রিল-২০১৬) চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছে এবং ২১ সেপ্টেম্বর অনুসমর্থন করে এর সপক্ষে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছে। কপ-২১ চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল বিশ্বের ৫৫ দেশের অনুসমর্থন, যারা বিশ্বের মোটের ওপর ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ।
এরই মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণকারী ৮৪টি দেশের সংসদে ওই চুক্তির অনুসমর্থন অনুমোদন করা হয়। তথ্য পাওয়া গেছে, গত ২৪ অক্টোবরের মধ্যে ১৯১টি দেশ চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছে। উল্লেখ করা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৮৪টি সদস্য দেশ, যারা মোট বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে ভারত ও চীন প্রথম থেকেই এ চুক্তির বিরোধী ছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করার কারণেই মূলত বৈশ্বিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এবং প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু চুক্তির বাধ্যবাধকতা থাকায় তারাও সেটাতে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিধর দেশ এবং তারাই মূলত জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সে জন্য তারা শেষ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে সহযোগিতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
গত বছর কপ-২১ প্যারিস সম্মেলনে, আগে অনেক সন্দেহ থাকলেও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেখানে উপস্থিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মেকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা যে শুধু সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেই তাঁর দায় সারেন তা-ই নয়, তিনি সেখানে কার্বন নির্গমন হ্রাস, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস বিষয়ে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ সমন্বয়ে একটি বাধ্যবাধকতা চুক্তি স্বাক্ষরেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
বলা চলে, মূলত যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ না নিলে এবং তারা আন্তরিক না হলে এ চুক্তি কখনোই স্বাক্ষর করা সম্ভব হতো না। তার আগে ১৯৯৫ সালে কপ সম্মেলন শুরু হওয়ার পর ১৯৯৭ সাল থেকেই এ রকম একটি চুক্তি করার তোড়জোড় চলছিল। তা ছাড়া ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমিয়ে দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। সেভাবেই প্যারিস সম্মেলনে সিদ্ধান্ত এসেছে। কিন্তু এবার হলো সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পালা। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু বাদ সেধেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারকালে বর্তমানে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগের ওবামা প্রশাসনের কয়েকটি নীতিনির্ধারণী বিষয় সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবভঙ্গি প্রদর্শন করেছিলেন। তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য স্বাক্ষরিত বাধবাধকতা চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের নেতিবাচক ও বিপরীতমুখী অবস্থান রয়েছে তাঁর।
সে জন্য এবার যদিও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন একে কোনো সমস্যা হিসেবে দেখছেন না, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণার শঙ্কায় রয়েছেন সবাই। কারণ, এরই মধ্যে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে তাদের যে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার কথা ছিল, তা এখনো দেয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নিজের উদ্যোগেই প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ফান্ড সৃষ্টি করে সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় করছেন। তা ছাড়া আগামী ২০২০ সালের মধ্যে যেন প্যারিস চুক্তিটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, সে জন্য তিনি দরিদ্র, স্বল্পোন্নত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য যাতে প্রতিশ্রুত তহবিল সময়মতো অনুদান হিসেবে ছাড় করে সেটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বক্তব্য রাখছেন।
তাঁর এ বক্তব্যের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দেশের প্রতিনিধিরা। কাজেই সম্মেলনের শেষ দিন, অর্থাৎ ১৮ নভেম্বর মরক্কোর মারাকেশ ঘোষণার মাধ্যমে হয়তো সব ভয় ও শঙ্কাকে পেছনে ফেলে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত পাব বলেই প্রত্যাশা করি।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।