প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ : নীরব দিব্য দ্যুতির নাম

শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
নামটি উচ্চারণ করলেই যেন মাথার ভেতরে ভেসে ওঠে এক অনড় দীপ্তি। কেবল নাম নয়, তিনি যেন এক জীবন, এক আলো, এক জেদি মানুষ, যে সামনে এগিয়ে যায়... পিছন ফিরে চায় না। তাঁর জীবন যেন স্থিত জ্যোতির দীপ্তিতে আলোকিত এক দীঘল পথ, যার প্রত্যেক বাঁকে প্রকাশ পেয়েছে এক অপরাজেয় সত্যবোধ।
১৯৩১ সালের শেষ দিন, জুলাইয়ের এক দুপুরে, খুলনার দৌলতপুরে জন্মেছিলেন তিনি। তখনকার সময়ের মতো সাধারণ এক ঘরে-কিন্তু ঘরটি ছিল অচেনা এক স্বপ্নে মোড়া। পিতা শেখ মুহাম্মদ হানিফ, শিক্ষকের চাকরি করতেন। সে চাকরি যে একদিন সংসারের মতো ভরে যাবে দায়ে, সে কথা তিনি জানতেন। মা মরিয়ম খাতুন, অল্প কথা বলতেন, কিন্তু চোখে ছিল এমন এক ধরনের আশীর্বাদ-যা সন্তানকে শিখিয়ে দেয়, পথ কেমন করে দীর্ঘ হতে হয়, আর মানুষ কেমন করে হয় বড়।
শহীদুল্লাহ ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই আলাদা। খেলায় খুব আগ্রহ ছিল না, কিন্তু বইয়ের পাতায় চোখ ফেললেই চুপ হয়ে যেতেন। স্কুলের পড়া-প্রথমে বণিকপাড়া, পরে দৌলতপুরের মুহসীন হাই স্কুল-যেখানে তাঁর পিতাই শিক্ষক। বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন-কারণ, বই ছিল একটা, খাতা ছিল অল্প। অভাব একটাই ছিল-অর্থের; কিন্তু সংকল্প, জেদ আর ইচ্ছেতে ছিল অঢেল সমৃদ্ধি। মাত্র চৌদ্দ বছর সাত মাস বয়সে পাস করলেন ম্যাট্রিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। প্রথম বিভাগে। পাড়াগাঁয়ের এই ছেলের কীর্তি তখন কান পাতলেই শোনা যেত।
তারপর... জীবন বাঁক নেয়। বড় ভাই যায় ঢাকায়, সিএ পড়তে। শহীদুল্লাহ রয়ে যান খুলনায়-ব্রজলাল কলেজে। পয়সা ছিল না বেশি, কিন্তু বাবার স্বপ্ন ছিল একটাই-ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। সেই স্বপ্নকে শহীদুল্লাহ মনে রেখেছিলেন, বুকের বাঁ পাশে গাঁথা ছিল যেন। ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েটে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯তম, ১৯৫০ সালে বিএসসিতে দ্বিতীয়। সেই বছরই ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম, বৃত্তি পান-মাসে পঁচিশ টাকা। পকেটে আরও পঁচিশ, বাবার জোগাড় করে দেওয়া সৈয়দপুর ফান্ড থেকে। কাপড় ছিল দুই সেট, শীতে একটি চাদর-সেই নিয়ে চার বছর কেটে গেল। পরীক্ষার ভাইভায় যখন জিজ্ঞেস করা হয়-“এই পোশাক কেন?” তিনি কেবল বলেন, “বাবা-মার সামর্থ্য নেই। আমি এসেছি তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করতে।” যে উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তারা চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। এই ছিলেন শহীদুল্লাহ। সোজা কথা, সোজা পথ, সোজা চোখে তাকিয়ে থাকা সত্যের দিকে।
সেই কলেজ থেকে গোল্ড মেডেল পেয়ে বের হন ১৯৫৪ সালে। শিক্ষকতা করতে চাননি, কারণ কলেজের অধ্যক্ষের আচরণে ততদিনে জেনেছেন-সব শিক্ষকই আদর্শের রূপ নন। তিনি চলে গেলেন মাঠে, সরাসরি কাজে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে শুরু, এরপর চিফ ডিজাইনারের অধীনে কাজ।
সুযোগ থাকলেও তিনি সরকারি চাকরিতে যাননি। কারণ, নীতি যেখানে নত হয়, সেখানে শহীদুল্লাহ মাথা নোয়াতেন না। নিজেই প্রতিষ্ঠান গড়লেন। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে স্থাপত্য-প্রকৌশল সংস্থা। চারুকলা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-যা যা দাঁড়িয়ে আছে আজ, তার শিকড়ের নিচে আছে শহীদুল্লাহর নাম, তাঁর গণনা, তাঁর অঙ্ক। কিন্তু জীবন কী এমন সমতল? ১৯৬৯ সালে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁকে চায় না-তিনি সাহায্য করেছেন এক মার্কসবাদী সংগঠনকে। কারাগারে পাঠানো হয়। রিমান্ড, জেরা, অমানবিক নির্যাতন-তাঁকে ভাঙতে পারেনি। বরং কারাগারে বসেই শুনলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর দুই ভাইকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে-লাশ ফেলে রেখেছে পুকুরে।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এমন কথা শুনে মানুষ ভেঙে পড়ে। না, শহীদুল্লাহ ভাঙেননি। উনি বরং আরো একবার নিজেকে গড়েছিলেন ভেতরে ভেতরে। স্বাধীনতা এলো। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে তখন ঢাকায় বিজয়ের গান। কিন্তু ভেতরে তাঁর চোখে ছিল ভাইদের হারানোর শোক। ‘বাস্তুকলাবিদ’ তখন ভেঙে পড়েছে। তিনি শুরু করলেন নতুন প্রতিষ্ঠান- ‘শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’। এখান থেকে শুরু হয় আরেক ধারা-বাংলাদেশে প্রথম রেট্রোফিটিং কৌশল প্রবর্তন। ভূগর্ভস্থ কলাম শক্ত করার কৌশল, যা আজও বহুল ব্যবহৃত।
কিন্তু... সততার মানুষ ব্যবসায়িক জগতে সবসময় টেকে না। সহকর্মীরা আপস করতে চায়, তিনি রাজি হন না। নিজের প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাদের হাতে তুলে দিয়ে তিনি আবারও সরে যান। গড়েন ‘শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস’-নিজ হাতে, নিজ বিশ্বাসে।
একবার কক্সবাজারের এক হোটেলের ছাদে ফাটল ধরেছে। বিমানবন্দরে আড়ম্বর অভ্যর্থনার জন্যে অপেক্ষমানদের রেখেই তিনি চলে গেলেন ছাদ দেখতে। নিরাপত্তারক্ষী জিজ্ঞাসা করলেন-
‘আপনি কে?’ তিনি বললেন-‘শহীদুল্লাহ।’ রক্ষী থমকে গেল, এমন সাধারণ পোশাকে এমন একজন? তিনি সাধারণ ছিলেন না, কিন্তু সাধারণের মতো জীবন কাটিয়েছিলেন। বাসে যেতেন, সময় মেনে চলতেন, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর মধ্যে ছিল এক বিরল সংমিশ্রণ-ইস্পাতের মতো কঠিন যুক্তি, শিশিরের মতো কোমল মানবতা।
কেবল প্রকৌশলী ছিলেন না তিনি। ছিলেন সমাজচিন্তক, আন্দোলনের সংগঠক। ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’। তিনি হন আহ্বায়ক। বিভক্ত রাজনীতি, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকেও এক করেছেন তিনি। দেশের স্বার্থে, মানুষের অধিকারে, নীতিতে তিনি ছিলেন আপসহীন, কড়া, অথচ আশ্চর্য হৃদয়বান। তিনি ছিলেন এক স্বপ্নচিন্তক মানবদর্শী, যিনি বিশ্বকে দেখেছিলেন ভিসামুক্ত এক মানবিক পৃথিবীর স্বপ্নে। শ্রমজীবী মানুষ কাজের জন্য দেশ থেকে দেশে কাজ করে অন্য দেশে যেন যেতে পারে, এই ছিল তাঁর কল্পনা। অনেকটা জন লেননের সেই ‘Imagine’ গানের কলির মতো, “Imagine all the people Sharing all the world”। যে ছেলেটি ছোটবেলায় কুমড়া বেচে ইংরেজি খবরের কাগজ কিনত, সে-ই একদিন হয়ে ওঠে ইংরেজি ভাষায় সুদক্ষ, বিশ্ব-দৃষ্টিসম্পন্ন প্রকৌশলী।
তাঁর মধ্যে ছিল কঠোর যুক্তি, ছিল কোমল হৃদয়। ছিল নির্লোভ জীবন, অমায়িক স্বভাব। অতি সামান্য সময় তাঁর পাশে থাকা যেকোনো মানুষই পরিচয়ের এক সময় ‘ভাই’ বলেই ডাকত-স্নেহ, শ্রদ্ধা ও আস্থার স্বরে। কত শত মানুষ তার একান্ত প্রয়োজনে, শিক্ষার তাগিদে অথবা সামাজিক আন্দোলনে বা মানবিক কল্যাণে তার দ্বারস্থ হয়েছেন, তার যেমন ইয়ত্তা নেই, তেমনি খালি হাতে ফিরেছেন, সেরূপ ঘটনাও বিরল!
তাই তিনি আমাদের কাছে ‘শহীদুল্লাহ ভাই’- নাম নয়, এক চরিত্র। তিনি থেকে যাবেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের সমাজচেতনায়- একজন অগ্রসর সূর্যালোকের মতো, যিনি আলো দেন, পথ দেখান, আর জীবনের শেষ পর্যন্ত সত্যের মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
স্থাপত্যে আমাদের শেখানো হয়েছিল-
-ইঞ্জিনিয়াররা হিসাব করে, স্থপতিরা স্বপ্ন দেখে।
শহীদুল্লাহ স্যার সেই পাঠ উল্টে দিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন নকশার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্মাতা।
যাঁর মানচিত্রে দেশ ছিল, যাঁর রুলারে ছিল দেশ গুছিয়ে দেবার প্রত্যয়।
আমরা আঁকতাম দালান-তিনি জোড়া লাগাতেন ভিত।
আমরা আলো ফেলতাম জানালায়-তিনি আলোকে ডাকতেন অন্দরের গভীরে।
তিনি কথা কম বলতেন, মুচকি হেসে ভাবতেন বেশী, সাইটে দাঁড়িয়ে থেকে বলতেন, “দেখো, ভবনের ভুল ধরা যায়। মানুষেরও যায়-শুধু দেখতে জানতে হয়।”
শুধু স্থপতি নয় বরং পরিবেশকর্মী হিসেবে, আমি বলি- এই মানুষটিকে কেবল ‘প্রকৌশলী’ বলা যথেষ্ট নয়।
তাঁর হাতে গাঁথা ছিল সততা, নিষ্ঠা, অভিমান আর অনমনীয়তা।
যার নকশা ছিল নিজের জীবনটিই-কোনো রেখা টানা হয়নি, তবু ভুল হয়নি কোথা, পথও হারায়নি কখনও।
তিনি ভবনের ছাদে উঠতেন নিজের পায়ে, পরিচয় না দিয়েই।
আর নিচে নামতেন এমনভাবে, যেন রেখে গেলেন কিছু ভার-যেটা আমরা চোখে দেখি না, কেবল অনুভব করি প্রত্যয়ী কাঠামোর দীর্ঘ ছায়ায়।
এইরকম মানুষ আলো ফেলে যান না-
নিজেই দিব্য দ্যুতি হয়ে যান।