মনের মধ্যে থাইক্ষ্যং পাড়া
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য। আরও বেশি সৌন্দর্য, পাহাড়ের পেটে ঝরা ঝর্ণায়। যা চোখ ধাঁধানো, মন জুড়ানো। এ পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো পাঁচ দিন। হেঁটেছি বান্দরবানের থানচি থেকে রুমা উপজেলার দুর্গম সব পাহাড়ে। দেখেছি, ছয়টি ঝর্ণার মায়াবী রূপ। পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করা পাহাড়িদের জীবনাচরণ দেখেছি, শুনেছি তাদের টিকে থাকার গল্প।
তবে পাহাড়ি এ পথ অনেক কঠিন। যদিও তারচেয়ে বেশি নান্দনিক। জীবনের ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর সময়গুলো নিয়ে এ লেখা। আজ থাকছে যার সপ্তম পর্ব। চলুন, পাহাড় অভিযানের চতুর্থ দিন সোমবার দুপুর থেকে হেঁটে আসি।
সেই শুক্রবার সন্ধ্যা, যে সন্ধ্যায় আমরা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পাহাড় টপকে ‘অফ রোডে’ ঢুকেছিলাম! যে পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা চলমান। আহ, কী ভয়ংকর এক মায়া জড়ানো সেই সন্ধ্যা। নিষিদ্ধ পথের অদ্ভুত সুন্দর সব স্মৃতি, যা এখনো জীবন্ত!
সন্ধ্যার পর পাহাড় টপকে এক জঙ্গলে ৩০ মিনিট লুকিয়ে থাকা। তারপর চাঁদের গাড়িতে চড়ে রাতে থানচির গহিনে ঢোকা। গন্তব্য, বাকত্লাই পাড়া। শনিবার সকালে সেখান থেকে আমাদের পাহাড়ি অভিযানের হাঁটাহাঁটি শুরু। এভাবে একে একে পাঁচটি পাহাড়ি পাড়া এবং বহু পাহাড় মাড়িয়ে আমরা এখন থাইক্ষ্যং পাড়ায়।
এ পাড়া পর্যন্ত আসতে আমরা টানা তিনদিন হেঁটেছি। এর মধ্যে ক্লান্ত শরীরে রাতের ঘুম ছাড়া আর বিশ্রামের সুযোগ পাইনি। পুরো সময় দৌড়ের ওপর। সকালে চোখে সেঁটে যাওয়া ডাবল ফলস দেখে পুনরায় এ পাড়ায় ফিরি। গোসল-খাওয়া সেরে দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে যাই।
সোমবার, বিকেল সাড়ে ৪টা। ঘুম থেকে মাত্র উঠলাম। সারা শরীর ব্যথা। তবু ভালো লাগছে, চিন্তাহীন ক্ষণিক বিশ্রাম পেয়ে। আরাম-আয়েশে বিছানা ছাড়ি। হাত-মুখ ধুয়ে নেমে পড়ি মিশনে। মিশন, এ পাড়ার মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার। তাদের গল্প শোনার। উপলব্ধি ভাগাভাগি করার।
থাইক্ষ্যং পাড়ায় ৮০টির মতো পরিবার আছে। এসব পরিবারে ৩৫০ থেকে ৪০০ মানুষের বাস। ভীষণ পরিপাটি এক পাড়া। পাড়ার রাস্তায়ও ময়লা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। কাঠের ঘরগুলো আরো চকচকে, চমৎকার। তিনটি দোকান রয়েছে এ পাড়ায়। এ পাড়ার মানুষ দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন। চা-বিড়ি খান। যদিও স্থানীয়দের তেমন কিছু কিনতে হয় না। দু-চারটি জিনিস ছাড়া প্রায় সবই পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে তারা। এসব দোকানে ভ্রমণকারীদের লক্ষ্য করে নানা জিনিস রাখা হয়।
থাইক্ষ্যং পাড়ায় যেতে হাঁটার বিকল্প নেই। ফলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে থানচি অথবা রুমা থেকে জিনিসপত্র কিনে আনেন দোকানি। বিকেল ৫টা। ঠিক এমন সময় একটি দোকানে যাই আমি আর রনী ভাই। গিয়েই কয়েকটি কলা খাই। আগেই শুনেছি, পাহাড়ি কলা অনেক স্বাদের। খাওয়ার পর মনে হলো, এত স্বাদের কলা আগে কখনো খাইনি। ওদের তৈরি করা চা, অসাধারণ।
দোকানের বাইরে কয়েকজন পাহাড়ি শিশু খেলা করছে। আমি বম ভাষা বুঝি না। ওরা বম ভাষায় কথা বলছে। ফলে, বাংলায় জানতে চাইলাম; এ খেলার নাম কি? শিশুরা মুখের দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে হাসতে থাকে। খেলাটি দেখতে এত ভালো লাগছিল যে, ভিডিও করা শুরু করি। ভিডিও করা শেষে তা দেখছি, এমন সময় শিশুরা পাশে এসে দাঁড়াল। কথা বলার চেষ্টা করলাম। মনে হলো খুবই সহজ-সরল ওরা।
দোকানদার চা দিলেন। আমরা গল্প করছি। গল্পের ছলে দোকানদার জানালেন, শিশুদের এ খেলার নাম ‘গিরা’। এ পাড়ার নিয়মিত খেলা এটি। সব সময় খেলে বাচ্চারা। কখনো-সখনো বড়রাও খেলেন। শুধু এ পাড়ায় নয়, পুরো পাহাড়িদের কাছে খেলাটি ঐতিহ্যবাহী। গল্পের ছলে দোকানি জানালেন, তাঁর চার ছেলে-মেয়ে। স্ত্রী জুম চাষ করেন। দিনের অনেক সময় পাহাড়ে থাকেন। আর তিনি দোকানে বসেন। কখনো-সখনো পাহাড়েও যান।
থাইক্ষ্যং পাড়া পর্যন্ত যেতে আমাদের বহু ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে। দোকানির কাছে জানতে চাইলাম, দোকানের মালপত্র কীভাবে আনেন? তিনি জানালেন, অধিকাংশ জিনিসই সারাদিন হেঁটে বান্দরবানের থানচি অথবা রুমা থেকে কিনে আনতে হয়। সব সময় যাওয়ার সুযোগ হয় না তাঁর। আবার কখনো-সখনো ‘মুঠি’ (কুলি) দিয়েও আনান। তবে, এ জন্য অনেক টাকা মুঠিকে দিতে হয়। ফলে, জিনিসপত্রের দাম পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়ে যায়।
দোকান থেকে বেরিয়ে এক শিশুর সঙ্গে দেখা। দেড় বছর বয়স। মায়াবী চেহারা। নাম ইয়াচিং। শিশুটি সব সময় তার বাবা-মায়ের কোলে-পিঠে থাকে।
থাইক্ষ্যং পাড়াটি উঁচু পাহাড়ের ওপর। লম্বা সারিতে সব ঘর-বাড়ি অবস্থিত এখানে। পাড়ার চারিপাশে অনেক নিচু স্থান। ফলে, এদিক-ওদিক হলেই নিচে পড়ে যেতে পারে শিশুরা। সেজন্য, ছোট্ট শিশুদের সব সময় কোলে-পিঠে চাদর দিয়ে আটকে রাখেন তাদের বাবা-মায়েরা।
সেখান থেকে বের হয়ে পাড়া ঘুরছি আমি, শাকিল, রুবেল ও রনী ভাই। লুঙ্গি পরে আছি। পাড়া ঘুরতে ঘুরতে দু-চারটি ছবিও তুললাম। হঠাৎ নজর গেল দুজন পাহাড়ি নারীর দিকে। তারা কাঁধে করে পাহাড় থেকে মারফাসহ কিছু সবজি তুলে নিয়ে পাড়ায় ফিরছেন। জিজ্ঞেস করার পর এক নারী জানালেন, পাহাড়ি ক্ষেত থেকে এগুলো তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। ছবি তোলার দৃশ্য দেখে বিরক্ত হচ্ছেন, তা বোঝা গেল। পরে আর ছবি তুলিনি।
সন্ধ্যা নামল। গত দুদিন বাড়িতে কথা হয় না। গতকাল রাতে অনেক চেষ্টা করেও মায়ের সঙ্গে কথা হয়নি। একজনের কাছে জানতে চাইলাম, এ পাড়ার কোথাও মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না? তিনি জানালেন, পানির ট্যাংকির পাশে যেতে। গেলাম। দেখি, সেখানে দুটি ছোট ছোট বাঁশের লাঠি পুঁতে রাখা।
আমাদের দেখে একজন পাহাড়ি জানালেন, ওই লাঠির ওপর মোবাইল না রাখলে নেটওয়ার্ক পাব না। মোবাইল রাখা হলো। কিন্তু, নেটওয়ার্ক আসে না। অনেক চেষ্টার পর একটু নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল। টু-জি নেটওয়ার্ক। আসে আর চলে যায়। আমি মাকে কল দিলাম। ভাঙা ভাঙা কথা হলো। আব্বাজানকে আর কল দিতে পারিনি। রনী ভাই বারবার চেষ্টা করেও ভাবির সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। মোটেও নেটওয়ার্ক আসেনি তাঁর ফোনে। রুবেল ভাই অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। কথা শেষে ফিরে আসি সেখান থেকে।
ফিরতে ফিরতে হঠাৎ নজর গেল একটি ল্যাম্পপোস্টের বাতিতে। দুর্গম পাড়ায় ল্যাম্পপোস্ট! বেশ অবাক হলাম। পরে শুনলাম, সৌর বিদ্যুতে জ্বলছে এ বাতি। বাতির নিচে এ পাড়ার শিশু থেকে যুবক, সবাই গিরা খেলছে। কেউ খেলছে, কেউ দেখছে। অনেকের হাতে স্মার্টফোন দেখা গেল।
সেখানে থাকা পাহাড়িদের কাছে প্রশ্ন ছিল, কবে থেকে গিরা খেলা চলছে? তাদের উত্তর, খেলাটা তারা জন্মের পর থেকে দেখে ও করে আসছে। গিরা খেলার মূল সরঞ্জাম হলো পাঁচটি বাঁশের গিরা। তিনটি গিরা মাটিতে রাখা হয়। দু-পক্ষের হাতে থাকা দুটি গিরা দিয়ে ওই তিনটা গিরায় ছুড়ে মেরে আঘাত করা হয়। আঘাত করতে পারলে পয়েন্ট, না পারলে হার।
এ পাড়ায় আসার আগে আমরা ছিলাম থিংদুলতে পাড়ায়। সেখানেও শিশুদের ‘ঢিল ছোড়া’ নামের একটি খেলা দেখেছিলাম। একজন আরেকজনের শরীরে ঢিল মারবে। অন্যজন তা আটকে দেবে। শরীরে লাগলে পয়েন্ট, না লাগলে হার। এটাই খেলার নিয়ম। পাড়ার অধিকাংশ শিশু মূলত এ ধরনের খেলা খেলে অভ্যস্ত। এসব খেলাকে ঐতিহাসিক খেলা বলেও জানান পাহাড়িরা।
দু-পাড়ার খেলা দেখে একজন মুরব্বির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, শিশুরা মারামারি ছাড়া আর কোনো খেলা করে না কেন? তাঁর উত্তর ছিল, এ ধরনের খেলা দেখে আমরা বড় হয়েছি। এসব মারামারি বা ঢিল ছোড়া মূলত আত্মরক্ষার জন্য দরকার হয়। কারণ, পাহাড়-জঙ্গলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। বলতে পারেন, নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছোট্টকাল থেকে শিশুদের এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
পাহাড়িদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাই একটি চায়ের দোকানে। গিয়ে চা খাওয়ানোর কথা বললাম। অ্যাজিং নামের এক তরুণী দোকানি চা বানালেন। তাঁকে উদ্যোক্তা নারী বলা যায়। তিনি পাহাড়ে জুম চাষ করেন। দোকান চালান। থাইক্ষ্যং পাড়া থেকে বান্দরবানের রুমা উপজেলার দোকানে হেঁটে যান। যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। সেখান থেকে উলের সুতা কিনে আনেন।
সেই উলের সুতা দিয়ে অ্যাজিং নিজ হাতে শীতের চাদর বানান। ওই চাদর নিজেই বিক্রি করেন। অনেক পরিশ্রমী একজন নারী অ্যাজিং। কথা বললেন বাংলায়। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। দেখে ভালো না লাগার উপায় নেই। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো। প্রথমে তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা দুটি চাদর কিনলাম। পরে আরেকবার গিয়ে আরও একটি চাদর কিনি। চাদরগুলো খুব সুন্দর।
সেখান থেকে যখন ফিরি, তখন রাত ৮টা। আমাদের এ পাড়ার স্থানীয় গাইডের সঙ্গে অনেক কথা হলো। এক সময় জানতে চাইলাম, এ পাড়ায় কারো করোনাভাইরাস হয়নি? তিনি জানালেন, ‘কারো করোনা হয়েছিল কি না জানি না। তবে, পাড়ার সবার একে একে জ্বর, কাশি, সর্দি, গলা ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট ছিল। অন্য সময় এ পাড়ায় বিভিন্ন এনজিওয়ের চিকিৎসক এলেও করোনার পর আর কেউ আসেননি।’
গাইডের কাছে জানতে চাইলাম, এসব রোগ সারল কীভাবে? উনি জানালেন, ‘কেউ কেউ হয়তো দু-একটি নাপা খেয়েছে। বেশিরভাগই ওষুধ খায়নি। যাদের জ্বর, কাশি, সর্দি, গলা ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট হয়েছে, তারা প্রথমে হলুদ থিতু করে সেদ্ধ করেছে। সেদ্ধ করার পর হলুদের যে ঝোল বের হয়েছে, সেই ঝোল খেয়েছে। সেই ঝোলেই সবার রোগ সেরে গেল!
এ কথা বলতে বলতে গাইডের যেন মন খারাপ হয়ে গেল। বলছিলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন নারী গুরুতর অসুস্থ হলেন। হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। কিন্তু, এখান থেকে হাসপাতালে নিতে হলে পাজা-কোলে বা কাঁধে ছাড়া নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখান থেকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে দু-ঘণ্টা হাঁটার পর পাহাড়ের মধ্যেই তিনি মারা যান। এখান থেকে কাউকে হাসপাতালে নিতে হলে তাকে কয়েক ঘণ্টার ঘাড়ে বা কাঁধে নিয়ে থানচি বা রুমার বগালেক পর্যন্ত নিতে হয়। তারপর হাসপাতালে নিতে হয়। এ এক ভয়ংকর সমস্যা।’
থাইক্ষ্যং পাড়ার কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম বিভিন্ন বিষয়ে। পাহাড়ের মানুষ মূলত পাহাড় থেকেই সবকিছু সংগ্রহ করেন। সাধারণত দিনের বেলায় অধিকাংশ নারী-পুরুষ পাড়ায় থাকে না। থাকে, পাহাড়ি জমিতে। চাষ করে। কারণ, তারা তেমন কিছু কিনে খায় না। নানা ধরনের সবজি ও জুমের চালসহ অনেক জিনিস তারা পাহাড় থেকেই পায়। যতগুলো পাড়ায় গিয়েছি, শুনেছি তারা মূলত তেল, লবণ, পেঁয়াজ ও রসুন কেনে। এর বাইরেও হয়তো দু-একটি পণ্য কিনে থাকে। যা আমি জানি না।
পাহাড় থেকে পাহাড়িরা যেসব পণ্য সংগ্রহ করে, তার অতিরিক্ত অংশ থানচি বা রুমার বাজারে বিক্রিও করে দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে বাজারে সবজি নিয়ে গেলেও ন্যায্য দাম পায় না তারা। তাদের আক্ষেপ, সারা জীবনই কম দামে ভালো জিনিস বিক্রি করতে বাধ্য হয় তারা। কোনো কীটনাশক ও রাসায়নিক ছাড়া উৎপাদন হওয়া এসব পণ্যের সঠিক দাম চায় তারা। এ ফসল বিক্রিই তাদের মূল আয়ের উৎস।
এ আয়ের বাইরে পর্যটকদের কাছ থেকে গাইড হিসেবে কাজ করেও আয় করে থাকেন অনেক যুবক। স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের নানামুখী কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর মিলিয়ে দিই বিছানায়। মনে মধ্যে থাইক্ষ্যং পাড়াকে রেখে কখন ঘুমিয়ে যাই, জানি না। অপেক্ষা ঘুম থেকে ওঠার। অপেক্ষা, বাকত্লাই ঝর্ণা দেখে চুরি করে ঢাকায় ফেরার।