পর্যটনে উপেক্ষিত প্রকৃতি

বাণিজ্য, সংরক্ষণ ও দূরদর্শিতার সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের পর্যটন। প্রকৃতিপ্রেমীদের অদম্য আকাঙ্ক্ষায় উন্মোচিত হচ্ছে নিত্য নতুন পর্যটন স্পটের দ্বার। কোথাও পর্যটকদের ঘিরে গড়ে উঠছে অবকাঠামো, কোথাও চলছে অবহেলার মাঝেই। তবে সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সুশৃঙ্খল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা— সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার অভাব ও উদাসীনতা লক্ষণীয়। অথচ প্রাকৃতিকভাবে দেশের পর্যটন খাত প্রস্তুত; প্রস্তুতি নেই শুধু আমাদের!
দেশের পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনার মূলে রয়েছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। সবুজ পাহাড়, বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, হাওর, নদী ও অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রকৃতিকে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রকৃতির এই অনন্য সৌন্দর্যগুলো আজ হুমকির মুখে। এছাড়া বন দখল, নদী দখল, প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস নিয়মিত ঘটনা। প্রশাসনের সামনে দিয়েই কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দিন-দুপুরে চলছে এসব দখল ও ধ্বংসযজ্ঞ।
দেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণগুলোর অবস্থা সংক্ষেপে আলোচনা করে পরিস্থিতির কিছুটা বাস্তব রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো :
অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবেশ দূষণ
কক্সবাজার : বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত হওয়া সত্ত্বেও কক্সবাজারে অপরিকল্পিতভাবে হোটেল, মোটেল, দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সৈকতের কাছাকাছি উঁচু দালান নির্মাণ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা এবং প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। অনেক সময় হোটেলগুলোর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। পর্যটন মৌসুমে সৈকতে আবর্জনার স্তূপ দেখা যায়, যা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেওয়ার পাশাপাশি সমুদ্র দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে।
সেন্টমার্টিন : দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে অতিরিক্ত পর্যটক চাপ, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, প্রবাল আহরণ এবং প্লাস্টিক দূষণ দ্বীপের জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। পর্যটন মৌসুমে দ্বীপের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পর্যটক প্রতিদিন ভিড় করে, যার ফলে প্রবাল ও সামুদ্রিক প্রাণীর বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নৌযান থেকে অতিরিক্ত তেল ও বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে সামুদ্রিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
সুন্দরবন : পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এটি পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা। তবে এই বনের অভ্যন্তরে বা এর কাছাকাছি শিল্প কারখানা স্থাপন, যেমন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র (যদিও এটি বনের কিছুটা দূরে অবস্থিত, এর সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে) এবং অতিরিক্ত জাহাজ চলাচল বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলি ও পরিবেশগত সচেতনতার অভাবও অনেক সময় সুন্দরবনের পরিবেশের ক্ষতি করে। এছাড়া অনেক পর্যটকই প্লাস্টিক বর্জ্যের যত্রতত্র ব্যবহারের বিষয়ে উদাসীন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণে উদাসীনতা
পাহাড়ি অঞ্চল : পাহাড়ি এলাকায় ঝরনা, নদী-লেক এবং বনাঞ্চলের অপরূপ সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটে। সারা বছরই পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। এখানেও পর্যটনকে ঘিরে যথেচ্ছ গাছ কাটা, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা ও স্থাপনা নির্মাণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব দেখা যায়। এছাড়া কখনও কখনও স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রতিও সংবেদনশীলতা দেখা যায় না, যা প্রাকৃতিক পরিবেশের মতোই তাদের জীবনযাত্রার অংশ। এর বাইরে নিয়মিত বন ও পাহাড় দখল চলছেই। এছাড়া যত্রতত্র গড়ে উঠছে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট।
হাওর অঞ্চল : বর্ষাকালে হাওরগুলো সুবিশাল জলরাশির রাজ্যে পরিণত হয়, যা মনোমুগ্ধকর এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা করে। বর্ষায় পর্যটকদের আনাগোনা থাকে সবচেয়ে বেশি। আর শুষ্ক মৌসুমে ঘটে বিপুলসংখ্যক অতিথি পাখির আগমন। বর্ষা মৌসুম তো বটেই, শুষ্ক মৌসুমেও হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। মাছের প্রজনন ক্ষেত্র রক্ষা, পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং হাওরের পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার দিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এছাড়া পর্যটকরা অনেক সময় পরিবেশ দূষণ করে এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের প্রতি উদাসীন থাকে।
পরিবেশগত সচেতনতার অভাব ও অপর্যাপ্ত আইন প্রয়োগ
সাধারণ পর্যটকদের মধ্যে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা প্রাকৃতিক স্থানে প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেট, বোতল ইত্যাদি ফেলে যায়, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। পর্যটন খাতে পরিবেশ দূষণ রোধে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রেই আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, যার ফলে পরিবেশের ক্ষতি বেড়েই চলছে।
টেকসই পর্যটন নীতির অভাব
বাংলাদেশের পর্যটন নীতিতে পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন খুব কম। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণের দিকে পর্যাপ্ত নজর দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকেও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যা টেকসই পর্যটনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশের পর্যটন খাতের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে প্রকৃতির সাথে এর সম্পর্ক কেমন হবে তার উপর নির্ভর করে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং পরিবেশ উপেক্ষা করে কেবল মুনাফার দিকে নজর দিলে দীর্ঘমেয়াদে এই খাতটি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটি সুদূরপ্রসারী, পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই পর্যটন নীতি গ্রহণ ও তার কঠোর বাস্তবায়ন জরুরি। ইকো-ট্যুরিজমের ধারণা, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, পর্যটক নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পিত পর্যটন উন্নয়ন প্রয়োজন। প্রকৃতিকে রক্ষা করেই কেবল বাংলাদেশের পর্যটন খাত বিশ্ব মঞ্চে তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারবে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারবে।