করোনার অতি সংক্রামক ধরনটিই ভারতে ছড়িয়েছে!

ভারতে নভেল করোনাভাইরাসের এক হাজারটি জিনোম সিকোয়েন্স করে দেশটির বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, করোনাভাইরাসের ‘এ২এ’ ভ্যারিঅ্যান্ট বা ধরনটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এটি ভারতে এসেছে মূলত ইউরোপ থেকে, করোনার উৎস চীন থেকে নয়। সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ খবর জানিয়েছে।
করোনা ‘আরএনএ’ গোত্রের ভাইরাস। এ ধরনের ভাইরাস মুহুর্মুহু মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজের গঠন বদলে ফেলে। নভেল করোনাভাইরাসও চীন থেকে সরাসরি বা নানা দেশ ঘুরে ভারতে ছড়িয়ে পড়ার ফাঁকে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এমন বহুরূপী ভাইরাসের নজরদারি করতে প্রয়োজন হয় জিনোম সিকোয়েন্স করা। করোনাভাইরাস কোন দেশ থেকে এসেছে, বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কীভাবে ছড়িয়েছে, জিনোম সিকোয়েন্স করলে মহামারির ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘ট্র্যাকিং’ ও ‘ট্রেসিং’ সহজে করা যায়। এসব তথ্য কাজে লাগে ভ্যাকসিন, ড্রাগের গবেষণাতেও। ভারতে প্রথম জিনোম সিকোয়েন্স করে পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি।
ভারতে কোভিড-১৯ রোগ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে কি না, তা নিয়েও গবেষণা চলছে। যে গবেষণায় জড়িত পশ্চিমবঙ্গের তিন প্রতিষ্ঠান—ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিকেল জিনোমিকস (এনআইবিএমজি), কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এনটেরিক ডিজিজেস (এনআইসিইডি বা নাইসেড) ও ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)।
পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি করোনার জিনোম সিকোয়েন্স করার পর ভাইরাল জিনোমে নজর রাখা শুরু করে হায়দরাবাদ ও নয়াদিল্লির সিএসআইআরের দুই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান ভারতের নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলের নমুনার ওপর সমীক্ষা করায় গোটা ভারতের চিত্র উঠে আসছিল না। এরপরই ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব বায়োটেকনোলজি প্যানইন্ডিয়া কনসোর্টিয়াম তৈরি করে। এর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনআইবিএমজিকে। পশ্চিমবঙ্গে ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল ও অরোফ্যারিঞ্জিয়াল নমুনা পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় নাইসেড ও আইপিজিএমইআরকে। সব মিলিয়ে ভারতকে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে ভাগ করে ১০টি রাজ্য থেকে নমুনা নেওয়া হয়। গত শনিবার সে গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন। এ প্রতিবেদনের যাবতীয় তথ্য তুলে দেওয়া হবে ফ্লু ভাইরাসের গ্লোবাল ডাটা ব্যাংকে।
গবেষণায় যা পাওয়া গেছে
এনআইবিএমজির পরিচালক সৌমিত্র দাস বলেন, “করোনা ভারতে এসেছে মূলত দুটি পথ ধরে। একটি ইউরোপ, অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। ইউরোপ (ইতালি, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও গ্রিস) থেকে এসেছে করোনার ‘এ২এ’ ধরনটি, যাকে এখন ২০এ, ২০বি, ২০সি—এ তিনটি ভাগে আলাদা করা হয়েছে। আর চীন থেকে এসেছে করোনার ‘১৯এ/বি’ ধরন। শুরুতে গত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে করোনার ধরনগুলোর বৈচিত্র্য চোখে পড়ছিল। কিন্তু গত জুনে ভারতে মূলত ‘এ২এ’ ধরনই ছড়িয়ে পড়ে।”
ভারতে করোনায় আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি। এর মধ্যে এক হাজার নমুনার ওপর করা গবেষণায় কি করোনা সংক্রমণের সার্বিক চিত্র প্রতিফলিত হবে? এ বিষয়ে সৌমিত্র দাসের ব্যাখ্যা, “আমরা শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ৯টি নমুনার ওপর কাজ করে ‘এ২এ’ ধরনের বেশি উপস্থিতি পাই। এক হাজারের ক্ষেত্রেও তাই দেখা যাচ্ছে। মনে হয় না, সার্বিকভাবে এর ব্যতিক্রম হবে। তবে আঞ্চলিকভাবে কিছু হেরফের দেখা যেতে পারে।’
গত এপ্রিলের শেষে এনআইবিএমজির দুই অধ্যাপক নিধান বিশ্বাস ও পার্থপ্রতিম মজুমদার ৫৫টি দেশের তিন হাজার ৬৩৬টি জিনোম সিকোয়েন্স পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, ভাইরাসের স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিনে একটি মিউটেশনের (ডি৬১৪জি) জন্য মানুষের ফুসফুসের কোষে সহজে ঢুকে পড়ছে ‘এ২এ’ ধরনের ভাইরাসটি। সাম্প্রতিক গবেষণায়ও বলা হয়েছে, মানবদেহের অ্যাঞ্জিওটেনসিং কনভার্টিং এনজাইম-২ বা এসিই-২ রিসেপটরের সঙ্গে অনেক সহজে মিশে যাচ্ছে ‘এ২এ’। আরো একটি সম্ভাব্য কারণ, মিউটেশনের ফলে গঠনগত পরিবর্তন হওয়ায় সংক্রমণ ঘটানোর পর মানবকোষে বেশি সংখ্যায় ভাইরাস পার্টিকেলের জন্ম দিতে পারছে। করোনার ‘এ২এ’ অতি সংক্রামক সে কারণেও।
ভারতের সাম্প্রতি গবেষণার সহগবেষক, এনআইবিএমজির অধ্যাপক অরিন্দম মিত্র বলেন, “শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকায় নভেল করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরন ভারতে ঢুকছিল। তাই সে সময় করোনার হ্যাপ্লোটাইপ বা ধরনগুলোর বৈচিত্র্য দেখা যায়। পরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন কোনো ধরন আর ভারতে আসেনি। যা ছিল, তার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে ‘এ২এ’। চীন থেকে ইউরোপে যাওয়ার পর এ মিউটেশন হয়, পরে ভারতে আসে। তবে চীন থেকে সরাসরি ভারতে আসা ধরনটি সেভাবে সংক্রমণ ছড়াতে পারেনি।”
এর পরের পদক্ষেপ কী?
মিউটেশনের ফলে করোনাভাইরাস ভয়ংকর হয়ে উঠল কি না, তা পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। মাসখানেকের মধ্যে ফল আসতে পারে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর করোনাভাইরাস কেমন প্রভাব ফেলছে, দেখা হবে তাও। ভারতের মতো জিনগত বৈচিত্র্যের দেশে যে উত্তর পাওয়া জরুরি। এ জন্য রোগীর পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যও নেওয়া হবে গবেষণায়। করা হবে আরো সিকোয়েন্সিং, চলবে নজরদারি।