করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পরীক্ষার ফল প্রকাশের দৌড়ে এগিয়ে থাকল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি নিরাপদ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম। প্রায় এক হাজার ৭৭ জনের ওপর পরীক্ষার পর দেখা গেছে, এই ভ্যাকসিন তাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি এবং হোয়াইট ব্লাড সেল বা শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে, যা শরীরের ভেতর করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। একে একটি বড় রকমের প্রতিশ্রুতিশীল আবিষ্কার হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারাহ গিলবার্টের দল জানিয়েছে, অ্যাডেনোভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে তৈরি এ ভেক্টর ভ্যাকসিন মানবদেহের বি-কোষ ও টি-কোষকে উদ্দীপিত করে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। যেহেতু নিষ্ক্রিয় ভাইরাসকে ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাই মানুষের শরীরে এ ভ্যাকসিনের কোনো ‘অ্যাডভার্স এফেক্ট’ বা ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না। এ ডিএনএ ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত বলেই দাবি করা হয়েছে।

শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাধান্য পাওয়া বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যান্টিবডি। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে এটি একটি মাত্র অংশ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অ্যান্টিবডি প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্বারা তৈরি ছোট প্রোটিন, যেগুলো ভাইরাসের পৃষ্ঠে লেগে থাকে। নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসের কাজকে অক্ষম করতে পারে। অন্যদিকে, টি-কোষ এক ধরনের শ্বেত রক্ত কণিকা, যা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সমন্বয় সাধনে সহায়তা করে এবং দেহের কোন কোষ সংক্রমিত হয়েছে, তা চিহ্নিত ও প্রতিরোধ করতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, অক্সফোর্ডের তৈরি ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১৪ দিন পর মানুষের দেহে টি-কোষ বেড়ে যেতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ২৮ দিন পর বেড়ে যাচ্ছে অ্যান্টিবডি। এখনো যেহেতু ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি, তাই এখনই বলা যাচ্ছে না যে এ দুটি কার্যকর ব্যবস্থা কত দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।

অক্সফোর্ড রিসার্চ গ্রুপের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেছেন, ‘ভ্যাকসিনটির ফলাফলে আমরা খুবই সন্তুষ্ট, যেহেতু আমরা এটি প্রয়োগের পর নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ও টি-কোষ তৈরি হতে দেখছি। এগুলো খুবই সম্ভাবনাময়। তবে সবাই যে বিষয়টি জানতে চান তা হলো, সত্যিই কি এটি কাজ করে, সুরক্ষা দেয়? এখানেই আমরা অপেক্ষার খেলায় রয়েছি।’

গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটির একটি ডোজের পর ৯০ শতাংশ মানুষের শরীরে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। মাত্র ১০ জনের শরীরে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ দেওয়া হয় এবং সবাই নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম হন।

অধ্যাপক পোলার্ড বলেন, ‘কী পরিমাণে এটির প্রয়োজন, তা আমরা এখনো বলতে পারছি না। তবে দ্বিতীয় ডোজের মাধ্যমে আমরা সর্বোচ্চ সাড়া পেতে পারি।’

ভ্যাকসিনটি কি নিরাপদ?

গবেষকরা বলছেন, এটি নিরাপদ। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আর সেটি বিপজ্জনক নয়। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর ৭০ শতাংশ মানুষ শুধু জ্বর নয়তো মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে প্যারাসিটামলের মাধ্যমেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট বলেন, ‘করোনা মহামারি প্রতিরোধে ভ্যাকসিনটি আসলেই কাজে দেয় কি না, এটি জানতে আমাদের আরো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তবে প্রাথমিক ফলে এটি আমাদের আশা দেয়।’

গবেষকরা বলেছেন, বয়স্কদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে আরো ক্লিনিক্যাল গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। পরীক্ষার এই ধাপের ফল গবেষণাগারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিমাপকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে। ভ্যাকসিনটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দেয় কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো পরীক্ষার প্রয়োজন।

এদিকে, সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের খবর সামনে আসার পর থেকেই হৈচৈ শুরু হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রজেনেকার তৈরি করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিন কবে বিশ্বের বাজারে আসছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য এখনো মেলেনি।

অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রজেনেকার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছিল গত এপ্রিল থেকেই। প্রথমে দুই ব্যক্তির শরীরে ইনজেক্ট করা হয়েছিল ভ্যাকসিন। তাঁদের মধ্যে একজন নারী বিজ্ঞানী। নাম এলিসা গ্রানাটো।  তারপর প্রথম পর্যায়ে কম সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করা হয়। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে এক হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবীকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এ দুই পর্যায়ের ট্রায়ালের রিপোর্টই ইতিবাচক বলে খবর সামনে এসেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চালাচ্ছিল অক্সফোর্ড। এ পর্যায়ের ট্রায়ালেও ভ্যাকসিনের প্রভাব সন্তোষজনক বলেই দাবি করা হয়েছে। যদিও ভ্যাকসিনের ডোজ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রতিবেদন সামনে আনা হয়নি। সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল এ খবর জানিয়েছে।