ভবানীপুরে ভোটগ্রহণ শেষ, বাক্সবন্দী মুখ্যমন্ত্রী মমতার ভাগ্য

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাইপ্রোফাইল ভবানীপুর বিধানসভা উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। ভবানীপুরের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাজ্যটির মুর্শিদাবাদ জেলার সামসেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুর বিধানসভা কেন্দ্র দুইটিতেও ভোট নেওয়া হয়।
কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে তিনটি কেন্দ্রে সকাল ৭টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, তা শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আগামী ৩ অক্টোবর তিন কেন্দ্রেই ভোটগণনা হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভবানীপুরে ভোট পড়েছে ৫৩ দশমিক ৩২ শতাংশ, সামসেরগঞ্জে ৭৮ দশমিক ৬০ এবং জঙ্গিপুরে ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
তবে সবার নজর ছিল ভবানীপুর কেন্দ্রটির দিকেই। তার কারণ দক্ষিণ কলকাতার এই কেন্দ্র থেকেই এবার ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আর মুখ্যমন্ত্রীর পদ টিকিয়ে রাখতে হলে এই নির্বাচনে অবশ্যই জিততে হবে মমতাকে। যদিও মমতার পক্ষে লড়াইটা খুব একটা সহজ নয় বলে অভিমত রাজনৈতিক মহলের।
তবে বুথ ফেরত ভোটারদের অভিমত, এই কেন্দ্রে মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজেই। কারণ মমতার প্রতিপক্ষ হিসেবে যে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি আছেন- বিজেপির প্রার্থী আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল ও সিপিআইএমের প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস-তারা উভয়েই রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবাগত। স্থানীয় বেশিরভাগ ভোটাররাই জানান, মমতার জয়ের সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি।
এদিন সকাল থেকেই ভবানীপুরের ৯৭টি কেন্দ্রের ২৮৭টি বুথের প্রায় প্রতিটিতেই ভোটারদের লম্বা লাইন চোখে পড়ে। এর মধ্যে নতুন ভোটার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বয়স্ক ভোটারও। বিকেল ৩টা নাগাদ হরিশ মুখার্জি রোডের মিত্র ইনস্টিউশন স্কুলে ভোট দেন মমতা। এরপর বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ ওই বুথেই ভোট দেন তাঁর ভাতিজা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ ছাড়াও চেতলা গার্লস হাইস্কুলে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে সপরিবারে ভোট দেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
যদিও ভোট নিয়ে মমতা বা অভিষেক এদিন কেউই কোনো মন্তব্য করেননি। তা ছাড়া রীতি অনুযায়ী ভোটের দিন বুথে বুথে ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে দেখা করেন প্রায় সব প্রার্থীই।
এদিন বিজেপি ও সিপিআইএম প্রার্থীকে নিজেদের কেন্দ্রে দেখা গেলেও ভোট দেওয়া ছাড়া গোটা দিন নিজেকে আড়ালেই রেখেছিলেন মমতা।
উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের কোনো গণ্ডগোল না হলেও বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে। তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে বুথ জ্যামের অভিযোগ তোলেন প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্ট প্রিয়াঙ্কাকে নিশানা করে ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘খুব সুন্দর ভোট হচ্ছে, মানুষ ভোট দিচ্ছেন। কোথাও বুথ জ্যাম হয়নি।’
অন্যদিকে খালসা হাইস্কুলে একজন ভুয়া ভোটারকে ঘিরে তুমুল হট্টগোল ও মারামারি শুরু হয়ে যায় তৃণমূল ও বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। বিজেপির অভিযোগ, ভুয়া ভোটার এনে ভোট করাচ্ছে তৃণমূল। ক্ষমতাসীন দলের পাল্টা অভিযোগ, ভুয়া ভোটার এনে অশান্তি ছড়াচ্ছে বিজেপি। পরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান ও পুলিশ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
অন্য একটি ঘটনায় শরৎ বোস লেনে বিজেপি নেতা কল্যাণ চৌবের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। এর পাশাপাশি ভোটের দিনই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও সুব্রত মুখার্জির বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভবানীপুরের মানুষকে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে। দুই মন্ত্রীকে আটক করারও দাবি তুলেছে বিজেপি।
তবে দুই দলের মধ্যে অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের মধ্যেই ভিন্ন ছবিও ধরা পড়ে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে চেতলায় সিপিআইএম’এর ক্যাম্পে গিয়ে মাটির ভাঁর হাতে চা খেতে দেখা যায় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আরে আমরা পাড়ার ছেলে। ছোট থেকেই বন্ধু। আমার বাবা, ওর বাবাও বন্ধু ছিলেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হতেই পারে কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি আলাদা।’ সেখানে থাকা সিপিআইএম নেতাকেও বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের সম্পর্ক রাজনীতির নয়, একটু অন্যরকম।’
গত মার্চ-এপ্রিলে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হলেও ভবানীপুরের বদলে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন মমতা। কিন্তু বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে পরাজিত হন তিনি। তবে মমতার পরাজয়েও তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে তার দল তৃণমূল কংগ্রেসকে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
গোটা রাজ্যে (মোট কেন্দ্র ২৯৪) ভোট নেওয়া ২৯২টি আসনের মধ্যে ২১৩টি আসন পায় ঘাসফুস শিবির। আর মমতার ছেড়ে যাওয়া ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হন সিনিয়র তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এরপর গত মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মমতাসহ তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা। সেক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই মমতাকে যে কোনো একটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে আসতে হতো। আর মমতার লড়াইয়ের পথ মসৃণ করতেই ভবানীপুর কেন্দ্রে থেকে ইস্তফা দেন শোভনদেব। ফলে ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন জরুরী হয়ে পড়ে।