ভারতের ওডিশায় আটকেপড়া ৮ বাংলাদেশি দেশে ফিরতে ব্যাকুল

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলমান লকডাউনে ভারতের ওডিশার মালকানগিরি জেলায় আটকা পড়েছেন আট বাংলাদেশি নাগরিক। তাঁদের মধ্যে তিনজন নারী। একদিকে তাঁদের ভিসার মেয়াদ শেষ, অন্যদিকে হাতে থাকা ভারতীয় রুপিও শেষ। ফলে খাদ্য সংকটে পড়েছেন তাঁরা। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাঁদের দাবি, অবিলম্বে যেন তাঁদের দেশে ফেরানো হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশের খুলনা জেলার ওই আট বাংলাদেশি ওডিশার মালকানগিরি জেলার পোতেরু এলাকায় এসেছিলেন দোলপূর্ণিমাসহ কয়েকটি ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে। এর পাশাপাশি ওই অঞ্চলে থাকা দূরসম্পর্কের কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতেও চেয়েছিলেন তাঁরা।
১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের অনেককে এ মালকানগিরিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। জানা যায়, গত ৮ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকেন ওই বাংলাদেশিরা। এরপর সড়কপথে ১১ জানুয়ারি তাঁরা মালকানগিরিতে পৌঁছান। ২১ ফেব্রুয়ারি কাঙ্গোরুকোন্ডাতে শিবরাত্রি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। গত ৯ মার্চ দোলপূর্ণিমার একটি অনুষ্ঠানেও যোগ দেন। এরপরই তাঁরা দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে গত ২২ মার্চ ভারতে জনতা কারফিউ দেওয়া হয়।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ২৫ মার্চ থেকে গোটা ভারতে জারি করা হয় লকডাউন। এ অবস্থায় মালকানগিরিতেই আটকে পড়ে ওই বাংলাদেশিরা। এরই মধ্যে গত ৮ এপ্রিল তাঁদের ভারতে থাকার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। পরে ভুবনেশ্বরে ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে আবেদন করলে তাঁদের ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এ সময় মালকানগিরি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের রেশনসহ অন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক ইস্যু হওয়ায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাঁদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে না। ওই আট বাংলাদেশি নাগরিক এ মুহূর্তে জেলার মালকানগিরির কালিমেরা এমভি ৯০ গ্রামে অবস্থান করছেন। আটকেপড়া বাংলাদেশিরা হলেন কালিদাস সরকার (৬০), তাঁর স্ত্রী সবিতা সরকার (৫৫) এবং তাঁদের মেয়ে চৈতালি সরকার (২৩), রসময় রায় (৫৫), তাঁর স্ত্রী রীতা রায় (৪৫), সুবীর কান্তি বিশ্বাস (৫২), প্রদীপ মণ্ডল (৩৬) ও রথীন্দ্র নাথ সরদার (৩৮)।
রসময় রায় বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বাসিন্দা। গত ৮ জানুয়ারি আমরা ভারতে আসি। সেদিন থেকেই আমরা ভারতে রয়েছি। জনতা কারফিউর পর আমরা একদিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাসায় পরিজনদের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু লকডাউন শুরুর পর গত দুই মাস আমরা মালকানগিরিতেই আটকা পড়েছি। এখানে প্রচণ্ড গরম ও খাওয়ার সমস্যা হচ্ছে।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যবস্থাই কি নেই যে আমরা যাতে এখন দেশে ফিরে যেতে পারি?’
চৈতালি সরকার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে লকডাউনে আমরা আটকে আছি। এদিকে, দেশের বাসার সবাই কান্নাকাটি করছে, তারা যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে আছে। এখানে আমরা আটজন সদস্য আছি। প্রত্যেকেরই পরিবার আছে। আমাদের কাছে কোনো অর্থও নেই। ফলে আমরা খুব সমস্যায় আছি। ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, যে করেই হোক, আমাদের যেন বাংলাদেশ পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয়।’
গণমাধ্যমের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাংলাদেশি নারী রীতা রায়। লকডাউনের মধ্যে স্থানীয় সরকারের পক্ষ যেসব সহায়তা করা হচ্ছে, তার প্রশংসা করেন তিনি। রীতা রায় বলেন, ‘আমাদের দুই মেয়ে বাংলাদেশে রেখে এসেছি। তাদের দেখার কেউ নেই। সেখানে সন্তানরা খুবই কষ্টে আছে। তাই অবিলম্বে আমাদের যেন ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। অন্ততপক্ষে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত যেন পৌঁছে দেওয়া হয়।’
মালকানগিরির জেলাশাসক মনীশ আগরওয়াল জানান, ‘ওদের ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আবারও সে মেয়াদ বাড়ানোর সংস্থান রয়েছে। যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক বিষয়, তাই তাঁদের দেশে ফেরার জন্য আইন মেনে আবেদন করতে হবে এবং সেটিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তা পাঠানো হবে। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এমন অবস্থায় ওই বাংলাদেশিরা বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে তাদের বিমানের টিকেট কাটতে বলা হলেও বাংলাদেশিরা বলছেন, তাঁদের বিমানের টিকেট কেনার ক্ষমতা নেই। জমানো অর্থ শেষ হওয়ার কারণে গাড়ি ভাড়া করে মালকানগিরি থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়ার মতো অর্থও তাঁদের নেই। চৈতালি সরকার মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার তাঁদের দুরবস্থার বিষয়টি অনুধাবন না করতে পারলে তাদের দেশে ফেরাটা অত সহজ হবে না।