যে তিন মেধাবী ছাত্রীর প্রতিবাদ চমকে দিয়েছে সবাইকে

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ঘিরে প্রতিবাদে মুখর বিভিন্ন রাজ্য। দেশটির মুসলিম বাসিন্দা ছাড়াও প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন ধর্ম ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। আহত হয়েছেন আরো অনেক মানুষ। আর এই উত্তাল ভারতের অসংখ্য বিক্ষোভকারীর মধ্যে যে কয়টি প্রতিবাদী মুখ সাড়া ফেলেছে, তাঁদের মধ্যে তিনজন অন্যতম। ঘটনাচক্রে তিনজনই নারী এবং তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী।
তিনজন হলেন কেরালা রাজ্যের এর্নাকুলামের আইনের ছাত্রী ইন্দুলেখা পর্থান, তামিলনাড়ু রাজ্যের পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগে এমএ পরীক্ষায় স্বর্ণপদক পাওয়া রাবিহা আবদুরেহিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্বর্ণপদক পাওয়া দেবস্মিতা চৌধুরী।
কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই তাঁদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাবের কাজে অংশ নেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া আর পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকাই ছিল তাঁদের কাজ। কিন্তু এখন এই তিন শিক্ষার্থীই হয়ে উঠেছেন আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ। সংবাদমাধ্যম বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তিন নারীর প্রতিবাদী চরিত্র।
ঘটনার সূত্রপাত রাজধানী নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তর প্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম পুলিশি হামলার পর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়। মাঠে নামতে থাকেন হাজারো শিক্ষার্থী। এরপরই সিএএর বিরুদ্ধে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
বিক্ষোভের শুরুতে সাদামাটাই থেকেছেন কেরালার ইন্দুলেখা পর্থান। এর আগে কখনোই প্রতিবাদ করেননি তিনি। হুট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ররা ক্লাসে এসে জানান, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘যারা বিক্ষোভ করছে, তাদের পোশাক দেখেই বোঝা যায়, এর পেছনে কাদের হাত রয়েছে।’ নরেন্দ্র মোদির এই কথাটিই যেন ঘুরছিল ইন্দুলেখার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিবাদের ভাষাও রপ্ত করেন তিনি, সঙ্গে নেন হিজাব। মুসলিম না হয়েও মাথায় হিজাব পরে যোগ দেন প্রতিবাদ মিছিলে। আর হাতে নেন একটি প্ল্যাকার্ড। সেখানে লেখা, ‘মি. মোদি, আমি ইন্দুলেখা। আমার পোশাক দেখে আমাকে শনাক্ত করুন।’
এ ব্যাপারে ইন্দুলেখা বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ করা দরকার। তখন মনে হয়েছিল, একজনও যদি আমার হিজাব পরার কারণ বুঝতে পারে, তাহলে সেটাই আমার সার্থকতা। কিন্তু পরে আমার হিজাব পরা ছবি যে এত ছড়িয়ে পড়বে, তা ভাবিনি।’
১৮ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার মনে হয়েছিল, শিক্ষার্থীদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। এর কারণ, আমরাই তো শিক্ষিত শ্রেণি, আমরাই তো ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে কারো নাম তালিকা থেকে বাদ যাবে, এটা তো আমাদেরই ভবিষ্যতের প্রশ্ন।’
ইন্দুলেখা জানান, তাঁর ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর পরিবার আর বন্ধুদের পাশে পেয়েছেন তিনি। অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে লিখলেও তা আমলে নিচ্ছেন না বলেও জানান।
তামিলনাড়ু রাজ্যের পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ বিভাগের ছাত্রী রাবিহা আবদুরেহিম। পড়াশোনায় মেধাবী হওয়ায় এমএ পরীক্ষায় স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি।
তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে হাজির হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। আর সেখানে সমাবর্তনে অংশ নিতে বন্ধুদের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন রাবিহাও। সেখানে কালো পোশাকের সঙ্গে মাথায় পরেছিলেন গোলাপি রঙের হিজাব। তাঁকে দেওয়া হবে স্বর্ণপদক।
সবাই যখন রাষ্ট্রপতির অপেক্ষায়, ঠিক ওই সময় হঠাৎ করে পুলিশ কর্মকর্তারা ডেকে নেন রাবিহাকে। তাঁকে বলা হয়, তাঁর সঙ্গে কিছু কথা আছে।
রাবিহা বলেন, ‘পুলিশ আমাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। এর আগে সিএএ আর এনআরসি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমি অনেক কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, সে কারণেই আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর যতক্ষণ রাষ্ট্রপতি সমাবর্তনে ছিলেন, ততক্ষণ আমাকে সভাস্থলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’
রাবিহা আরো বলেন, ‘কিছু শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি আর পদক দেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি বেরিয়ে যান। এরপর পুলিশ আমাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তখনো বাকি শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান চলছিল। মঞ্চে যখন পদক নেওয়ার জন্য আমাকে ডাকা হয়, তখন বলেছিলাম যে আমি পদক নেব না। আর এর মাধ্যমেই প্রতিবাদ করি।’
রাবিহা বলেন, ‘নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ করেছি বলে আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ জন্য অনেক অপমানিত হয়েছি আমি। আর কেনই বা সেই অপমান সহ্য করে স্বর্ণপদক নেব?’
তিনি বলেন, ‘পুলিশের ধারণা ছিল, রাষ্ট্রপতির সামনেই আমি প্রতিবাদ করব। আর সে জন্য যতক্ষণ রাষ্ট্রপতি ছিলেন, ততক্ষণ আমাকে আটকে রাখা হয়।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই সভার নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল পুলিশের হাতে। তাই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বলার ছিল না।
এরপরই এ ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আর রাবিহা হয়ে ওঠেন আরেকটি প্রতিবাদী মুখ।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দেবস্মিতা চৌধুরী। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে তিনিও পেয়েছেন স্বর্ণপদক। এদিকে সিএএ আর এনআরসি নিয়ে আগে থেকেই সরব ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে স্বর্ণপদক নিতে গিয়ে দেবস্মিতা চৌধুরী এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন, যার জন্য তাঁর বন্ধুরাও প্রস্তুত ছিলেন না। সমাবর্তনে স্বর্ণপদক নিতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইনের একটি কপি সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলেন তিনি। ওই সময় দেবস্মিতা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
এ ব্যাপারে দেবস্মিতা চৌধুরী বলেন, ‘আমার বন্ধুরা জানে যে আমি অনেক কম কথা বলি আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই পছন্দ করি। কখনো কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু পরিস্থিতিই আমাকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।’
দেবস্মিতা বলেন, ‘সরকারকে বুঝতে হবে, কেন এত মানুষ রাস্তায় নেমেছে। আমি সহিংসতাকে সমর্থন না করলেও সরকারের বোঝা দরকার যে দেশের মানুষের পরিচয় নিয়ে, অস্তিত্ব নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। কারো যদি নাগরিকত্ব না থাকে, তাহলে তার নিজের পরিচয় আর অস্তিত্ব থাকবে না।’