কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস যে ছবিটি

কথিত আছে, রাস্তায় গ্যাসের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পড়াশোনা করতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেই ছবিই যেন আবার ফিরে এলো ফিলিপাইনের মানদাউ শহরের রাস্তায়। রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে মেডিকেল কলেজছাত্রী জয়েসে টরেফ্রানকার চোখে পড়ল, ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁর নিয়নের আলোয় পড়াশোনা করছে এক পথশিশু।
বিরল এই দৃশ্যটি মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করে নিজের ফেসবুক ও টুইটারে পোস্ট করেন জয়েসে। ক্যাপশনে লেখেন, ‘পথশিশুটি আমার অনুপ্রেরণা।’ ছবিটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জয়েসের অ্যাকাউন্ট থেকেই ছবিটি শেয়ার করা হয় সাত লাখের বেশিবার। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে ছবিটি কয়েক কোটিবারের বেশি ব্যবহৃত হয়েছে বলে ফেসবুকের সূত্র উল্লেখ করে জানিয়েছে দ্য টেলিগ্রাফ।
ছবিটিতে সবারই মন্তব্য, শিশুটিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁরা। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো আকুইনো তাঁর টুইটারে ছবিটি পোস্ট করে লেখেন, ‘আপনার বেশি কিছুর দরকার নেই। আপনি যেটা অর্জন করতে চান তার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও মনোযোগী হওয়াটাই বেশি দরকার।’ শুধু দেশটির প্রেসিডেন্টই নয়, বিশ্বব্যাপী কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে এই ছবি।
অনুপ্রেরণার উৎস শিশুটিকে খুঁজে বের করেন ফিলিপাইনের সাংবাদিকরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নয় বছরের ওই পথশিশুর নাম ড্যানিয়েল ক্যাবরেরা। বাবা নেই শিশুটির। ড্যানিয়েলের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন চুরির অপরাধে জেলে যান বাবা। এর ছয় মাস পর একদিন খবর আসে, জেলেই মারা গেছেন তিনি। এর পর থেকেই মা আর দাদার (পিতামহ) মানদাউ শহরের রাস্তায় বড় হচ্ছে সে।
ড্যানিয়েল ফিলিপাইনে পথশিশুদের জন্য পরিচালিত একটি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র। রাস্তার পাশে একটি ছোট্ট খাবারের দোকানের পাশে পলিথিন টানিয়ে তৈরি করা ঘরে মা ও দাদার সঙ্গে থাকে সে। তাদের সেই ঘরের কোনো দেয়াল নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই ছোট্ট খাবারের দোকানে বসে ড্যানিয়েল জানায়, তার লক্ষ্য একজন ডাক্তার হওয়া কিংবা পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া।
পথশিশুদের জন্য পরিচালিত স্কুলের শিক্ষিকা রোসালিনা দেতুয়া ড্যানিয়েলকে ‘সুখী শিশু’ বলে মন্তব্য করেন। ‘সে মেধাবী এবং শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় সঠিক জবাবটাই দেয়, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ বলছিলেন রোসালিনা।
সাংবাদিকরা কথা বলেছেন ড্যানিয়েলের ছবি তুলে পোস্ট করা মেডিকেল ছাত্রী জয়েসে টরেফ্রানকার সঙ্গেও। জয়েসে জানান, একদিন রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে চোখে পড়ে দৃশ্যটি। তিনি দেখেন, ওই শিশুটি রেস্তোরাঁর যেটুকু আলো বাইরে আসছে, সেই আলোতেই একটি কাঠের টুলের ওপরে বই রেখে পড়াশোনা করছে।
দৃশ্যটি দেখে চোখে জল চলে আসে জয়েসের। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর দূর থেকে কয়েকটি ছবি তোলেন শিশুটির। ততক্ষণে পড়া শেষ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সে। বাড়িতে ফিরে ছবিটি পোস্ট করে লেখেন সেই আলোচিত ক্যাপশনটি। তবে ছবিটি যে এত মানুষের আবেগকে নাড়া দেবে তা ভাবতে পারেননি জয়েসে।
জয়েসে জানান, এরপরও তাঁর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছোট্ট ড্যানিয়েলকে নিয়ে লিখেছেন। তিনি লেখেন, ‘হাজারো প্রতিকূলতা থামাতে পারেনি ড্যানিয়েল ক্যাবরেরাকে। যে বয়সের বাচ্চারা বল নিয়ে মাঠে ব্যস্ত থাকে, সে বয়সে তার ভালোবাসা পড়াশোনার প্রতি। জানার আগ্রহ থেকেই নিজ উদ্যোগেই যাচ্ছে বিদ্যালয়ে। আর ঘরে কোনো আলো না থাকায় ছুটে গেছে খোলা রাস্তায়। রেস্তোরাঁর আলোর সাহায্য নিয়ে নিজেকে আলোকিত করতে মরিয়া ক্যাবরেরা।’
জয়েস আরো জানিয়েছেন, সামান্য ছবিটির অসাধারণ ক্ষমতা। তিনি তাঁর বন্ধুদের এই ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ড্যানিয়েলের স্বপ্নপূরণের জন্য তাঁর পাশে থাকতেও রাজি জয়েস। ড্যানিয়েলের পড়াশোনার খরচ চালানোর খরচ সংগ্রহের জন্য ফেসবুকে একটি পেজ খোলা হয়েছে বলেও টেলিগ্রাফকে জানান তিনি।