দুঃসময়ের পাশে দাঁড়ানোয় ভারতের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কৃতজ্ঞতা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের প্রতি ভারতবাসীর সহায়তার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতবাসী বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়ে খাবার ভাগ করে খেয়েছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতবাসীকে।’
আজ শনিবার পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট আমি ও আমার ছোট বোন রেহানা যখন বিদেশে, সেই সময় আমাদের পরিবারের ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই দেশের দুঃসময়ের সময় ভারত যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানিদের ট্রেনিং দিয়েছে ভারত।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘ভারতে গণতান্ত্রিক ধারা আছে। যে ধারার জন্য ভারত আজ উন্নতিতে গতি পেয়েছে। কিন্ত আমরা নিবিচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার পাইনি। মধ্যে সামরিক শাসন সেই গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করেছে। ফলে আমাদের দেশ পিছিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জাতির পিতা দেশ স্বাধীনের পর মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়তে তিনি বেশি সময় পাননি। বাংলাদেশের ওপর গত ২১ বছরে বারবার আঘাত নেমে এসেছে। কিন্ত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। শিক্ষাকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি।’
এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর ১১৯তম জন্মবার্ষিকীতে আমি তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরে গর্বিত। আমাকে যখনই নজরুলের নামের এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছি। বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি সম্মান পেয়েছি এবং অনেক জায়গা থেকে সম্মান দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া আছে আমাকে। কিন্তু আমাদের দেশের জাতীয় কবির নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে সম্মান জানানো হবে জেনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।’
দুই বাংলার নানা লড়াই সংগ্রামে কবি নজরুলের অবদান অসামান্য। তাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় কবির নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানান শেখ হাসিনা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি : ফোকাস বাংলা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুই বাংলার প্রতিটি লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে নজরুল জড়িত। নজরুল ইসলাম যেমন ইসলাম ধর্মের নানা বিষয়কে অত্যন্ত সহজ ভাষায় মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন, তেমনি হিন্দু ধর্মের শ্যামা সংগীত ও কীর্তনকেও সহজভাবে মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন। আজ আমাদের সেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মদিনে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। গতকাল বাংলাদশে আমরা নজরুলের জন্মজয়ন্তী পালন করেছি। আজ পশ্চিমবাংলায় পালিত হচ্ছে। নজরুলের নামে আসানসোলে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য আমি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে কবির বাড়ি চুরুলিয়াকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার জন্যও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নজরুলের জন্ম এখানে হলেও, তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়েছিলেন। তাই আমরাও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নজরুলের নামে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে জয় বাংলা স্লোগান সেই স্লোগানটি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান নজরুলের কবিতা থেকেই নিয়েছিলেন। যে স্লোগানটি সারা দেশ মুক্তিযুদ্ধে উদ্বেলিত হয়েছিল।’
শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো উপমহাদেশকে দারিদ্র্য মুক্ত করতে চান বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সরকার বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছে ও গড়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে খুব কম সময়ে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। বাংলাদেশকে আজ অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছি আমরা। শুধু বাংলাদেশকেই নয়, আমরা চাই, গোটা উপমহাদেশ থেকে দারিদ্র্য দূর হোক এবং সমৃদ্ধশালী হোক। সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে চাই। আমরা মানবিকতাকে সবার উপরে রাখতে চাই। আর তাইতো প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের মানবিকতার খাতিরে আমরা আশ্রয় দিয়েছি।’
এ সময় শেখ হাসিনা কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদেরকে সবার আগে মানবতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ জানান।
এ সময় আবেগ আপ্লুত শেখ হাসিনা বলেন, ‘নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামের প্রেরণা। নজরুলের ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ আমাদের দেশের রণ সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাগ হতে পারে কিন্তু নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ ভাগ হয়নি। নজরুল আমাদের শক্তি ও চেতনা দিয়ে গিয়েছেন।’
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে দুই বাংলা যৌথভাবে গবেষণা করতে চায় বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা ভালো কিছু করতে গেলে দুই বাংলাকে বাদ দিয়ে করতে পারি না। আজ আমাদের মাঝে শেখ হাসিনাকে পেয়ে আমরা গর্বিত। শিক্ষাকে সার্বজনীন, পঠন-পাঠনকে আন্তর্জাতিক মানের করা ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে আজ পশ্চিমবঙ্গ সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।’
রাজ্যে শিক্ষার উন্নয়নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং কী উন্নয়ন করেছেন তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও তুলে ধরেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
আজ পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলা ১২টার দিকে পৌছান শেখ হাসিনা। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিল ২০টি গাড়ির কনভয় ও দুটি বাস। শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানাসহ বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ জনের একটি প্রতিনিধি দল।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ সম্মান শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের নামে উৎসর্গ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এই ডি. লিট উপাধি পেয়ে অভিভূত। কাজী নজরুলের নামের এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাওয়া বড় পাওনা। এই সম্মান গোটা বাংলাদেশের।’