মমতার পাশে দাঁড়াল বিরোধী দলগুলো

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআই হানার প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে ভারতের বেশির ভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। তারা প্রত্যেকেই মমতার এই লড়াইকে সমর্থন জানিয়ে তাঁর পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।
গতকাল রোববার রাতেই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মমতাকে সমর্থন জানিয়ে ফোন করেন। টুইটে সে কথা লিখে রাহুল বলেন, আমি নিজে মমতাদির সঙ্গে কথা বলেছি। আর বলেছি, আমরা তাঁর পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাংলায় যা হয়েছে তা মোদি এবং বিজেপির মিলিত আক্রমণ দেশের ওপর। এই ফ্যাসিবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের সব বিরোধীরা একজোট হয়ে লড়বে।
ভারতের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) সভাপতি শরদ পাওয়ার টুইটারে লেখেন, পশ্চিমবঙ্গের এই ঘটনা গণতন্ত্রের ওপর নিগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গে সিবিআইকে সম্পূর্ণ অপব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য সব বিরোধীরা একত্রিত হবে।
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি (টিডিপি) চন্দ্রবাবু নাইডু বলেছেন, আজ দেশের সমস্ত বিরোধী নেতারা দিল্লিতে এই ব্যাপারে বৈঠকে বসবে। তারপর দেশজুড়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে খসড়া কর্মসূচি তৈরি করবেন। তাঁর দলের সাংসদরা এই ইস্যুতে একযোগে প্রতিবাদ জানাবে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের (এনসি) নেতা ওমর আবদুল্লাহ টুইটারে লিখেছেন, আমি মমতাদিকে ফোন করে বলেছি, আমরা তাঁর ধরনাতে তাঁর পাশে আছি। সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা এবং মোদি সরকারের এভাবে কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলোর অপব্যবহার আজ সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
গুজরাটের দলিত বিধায়ক জিগনেশ মেওয়ানি টুইটারে মমতাকে সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন, ভারতের মাটিতে আজ গণতন্ত্র ও সংবিধান ধ্বংস হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহ মিলে সিবিআইকে দিয়ে কলকাতায় যা করেছে তা অঘোষিত জরুরি অবস্থা এবং ফ্যাসিবাদ। যেভাবে মমতাজির আধিকারীককে (পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার) সিবিআই নিশানা করেছে, তাঁর রুদ্ধে দেশজুড়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজবাদী পার্টির (এসপি) সভাপতি অখিলেশ যাদব টুইটারে লিখেছেন, বিজেপি যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকতে চায়। তারা এত ভয় পাচ্ছে যে সিবিআই নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা অগণতান্ত্রিক এবং সংবিধান বিরুদ্ধ। আমাদের দাবি সিবিআইকে এভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না।
মমতার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সমর্থনবার্তা পাঠিয়েছেন বহুজন সমাজবাদী পার্টির (বিএসপি) প্রধান উত্তরপ্রদেশের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল টুইটারে লিখেছেন, মমতাদির সঙ্গে কথা বলে তাঁর পাশে থাকার বার্তা আমি দিয়েছি। মোদি–শাহর এই কাজ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।
বিহার রাজ্যের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) নেতা লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী যাদব টুইটারে লিখেছেন, মমতাদিদির সঙ্গে কথা বলে আরজেডির সমর্থন জানিয়েছি। শুধু বিরোধী নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধেই বিজেপির এই বিষাক্ত মনোভাব নেই, সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধেও তাদের একই মনোভাব।
মূলত কলকাতার ব্রিগেডে মমতার ডাকে জনসভায় আসা মোদি বিরোধী মহাজোটের পক্ষে থাকা সব রাজনৈতিক দল কার্যত একাট্টা হয়ে কেন্দ্র রাজ্য সংঘাতের এও লড়াইয়ে মমতার পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে।
জানা যায়, কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমারকে জেরা করার জন্য রোববার সন্ধ্যায় সিবিআইয়ের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) তথাগত বর্ধনের নেতৃত্বে কলকাতার লাউডন স্ট্রিটে তাঁর বাসভবনে যায় ৪০ জনের বেশি একটি সিবিআইয়ের টিম। অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সারদা ও রোজভ্যালি চিটফান্ডে রাজীব কুমারের সম্পর্ক ছিল। সেই বিষয়েই তাঁকে জেরা করতে এদিন সিবিআই কর্মকর্তারা তাঁর বাসভবনে যান।
সিবিআইয়ের অন্তর্বর্তী প্রধান এম নাগেশ্বর রাও জানান, চিটফান্ড সংক্রান্ত মামলায় তথ্য লোপাট করার প্রমাণ রয়েছে রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে। সিবিআইয়ের দাবি, এর আগে রাজীব কুমারকে একাধিকবার সিবিআই দপ্তরে হাজির হওয়ার নোটিশ পাঠানো হলেও তিনি হাজিরা দেননি।
রোববার সন্ধ্যায় সিবিআইয়ের সদস্যরা পুলিশ কমিশনারের বাড়ির গেটের কাছে যেতেই বাধা দেয় কলকাতা পুলিশের বিশাল বাহিনী। শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি। পরে সিবিআইয়ের ডিসিপি তথাগত বর্ধনসহ কর্মকর্তাদের জোর করে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় কলকাতার শেক্সপিয়র সরণি থানায়। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলে কলকাতার সল্টলেকের সিবিআইয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর সিজিও কমপ্লেক্স, নিজাম প্যালেসসহ সিবিআই কর্মকর্তাদের বাসভবন। রাতেই সিবিআইয়ের সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এদিকে ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে পৌঁছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সেখানে উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক করেন। তার পরই মমতা জিহাদ ঘোষণা করেন কেন্দ্রের মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গে এসে নরেন্দ্র মোদি হুমকি দিয়ে যাওয়ার পরই আজ সিবিআই হানা শুরু করেছে। এটা জরুরি অবস্থার থেকেও ভয়ংকর। কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে সাংবিধানিক সংকট তৈরির চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মমতা বলেন, বাংলাকে ঘিরে অত্যাচার করছেন মোদি, অমিত শহরা। ২০১৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে না বুঝেই প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তিনি বলেন, চিটফান্ডের নাম করে প্রত্যেক জায়গায় জোর করে ঢুকে পড়ছে তারা। অথচ আমরাই প্রথম চিটফান্ডের মালিকদের গ্রেপ্তার করি। লোকসভা ভোটের আগে সিবিআইকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যাকে পারছে তাকে ডেকে হেনস্থা করছে সিবিআই। আমরা প্রত্যেকটি এজেন্সিকে সম্মান করি। কিন্তু অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।
মমতা অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ কমিশনারের মতো পদাধিকারীকের বাড়িতে বিনা ওয়ারেন্টে সিক্রেট অপারেশনে এসেছিল সিবিআই। ওদের সঙ্গে কোনো কাগজ ছিল না। দেশের সংবিধান আজ বিপন্ন।
এর পরই কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে ধরনায় বসে পড়েন মমতা। তিনি জানিয়ে দেন, যতক্ষণ না পরিস্থিতির বদল ঘটে, ততক্ষণ ধরনা চলবে। গান্ধীজির ধাঁচেই চলবে এই সত্যাগ্রহ অবস্থান ধরনা।
রোববার রাতভর সেখানে থাকেন মমতা ও তাঁদের নেতারা।
আজ পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বাজেট পেশ রয়েছে। তার আগে মন্ত্রিসভার বৈঠক রয়েছে। মমতা জানিয়েছেন, ধরনামঞ্চের পাশেই তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠক করবেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বিধানসভায় বাজেট পেশ করবেন।
অন্যদিকে, এই খবর দিল্লিতে পৌঁছানোর পরই সল্টলেকের সিবিআইয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর সিজিও কমপ্লেক্স, নিজাম প্যালেসসহ সিবিআই কর্মকর্তাদের বাসভবনের দখল নিতে নামানো হয় সিআরপিএফ (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স) বাহিনীকে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে পিছু হটে রাজ্য পুলিশ বাহিনী।
এদিকে, আজই সিবিআইয়ের পরিচালক পদে দায়িত্ব নিতে চলেছেন ঋষি শুক্লা। সিবিআই সূত্রে খবর, দায়িত্ব নিয়েই তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসতে চলেছেন। আজ বা কাল তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসবেন। এসে সিজিও কমপ্লেক্সে গিয়ে সিবিআই কর্মকর্তাদের মনোবল বাড়াতে বৈঠক করবেন। এরই মধ্যেই দিল্লিতে গতকালকের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম পাঠানো হয়েছে সিবিআইয়ের পরিচালকের কার্যালয়ে। যার মধ্যে একজন ডিসি, একজন এডিসি, দুজন পরিদর্শকসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কাজে বাধা ও মারধর করার অভিযোগ আনতে চলেছে সিবিআই। পাশাপাশি আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরিনাথ ত্রিপাঠির কাছেও বিষয়টি জানিয়ে সিবিআই অভিযোগ জানাতে চলেছে বলে জানা গেছে।