এনআরসি আতঙ্কে পশ্চিমবঙ্গে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬

ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) আতঙ্কে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। যত দিন যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি আতঙ্ক ততই সাধারণ মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এই আতঙ্কে এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ছয়জন।
এনআরসি আতঙ্কে গত শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে অন্নদা রায় (৩৮) ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে মন্টু সরকার (৫২) নামের দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। পরদিন শনিবার উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে হৃদরোগে মৃত্যু হয় মন্টু মণ্ডল (৩৬) নামের এক ব্যক্তির। ওই দিনই বসিরহাটের বাসিন্দা মোমিনা বেওয়া (৫৫) নামের এক নারীরও মৃত্যু হয়। গত রোববার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বসিরহাটে মৃত্যু হয় ইটভাটার শ্রমিক কামাল হোসেন মণ্ডলের (৩২)। ওই জেলারই শাসন এলাকায় মৃত্যু হয়েছে আয়েপ আলি (৫২) নামের আরো এক ব্যক্তির। তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর নেপথ্যে কারণ একটাই—নাগরিকপঞ্জি আতঙ্ক। মৃতের পরিবারের সদস্যরাও অভিযোগ করেছেন, তাঁদের পরিবারের মৃত সদস্যরা হয় রেশন কার্ড সংশোধন করতে গিয়ে, নয়তো ১৯৭১ সালের দলিল সম্পর্কিত সমস্যায় আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন।
গত ৩১ আগস্ট ভারতের আসাম রাজ্যে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পায়। চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তিন কোটি ১১ লাখের কিছু বেশি নাম। কিন্তু সে তালিকা থেকে বাদ পড়ে ১৯ লাখ ছয় হাজার নাগরিকের নাম। বিদেশি ট্রাইব্যুনালে তাঁদের পুনরায় আবেদন জানানোর সুযোগ থাকলেও বহু মানুষ দেশছাড়া হওয়ার আতঙ্কে দিন গুনছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ ঘিরে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এমন পরিস্থিতিতে আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি চালু করতে চায় বিজেপি। যদিও এনআরসি চালুর ব্যাপারে সরকারিভাবে এখনো কিছুই ঘোষণা করা হয়নি। তবু আসামের আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গেও। প্রতিদিনই রাজ্যের হাজার হাজার মানুষ রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এবং ১৯৭১ সালের আগের জমির দলিল সংগ্রহ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।
পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকপঞ্জির প্রতিবাদে এরই মধ্যে রাজপথে নেমেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায়ও প্রতিবাদী মিছিলে শামিল হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। কোথাও আবার প্রতিবাদের নামে সড়ক ও রেল অবরোধ হচ্ছে। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কুশপুত্তলিকাও পোড়ানো হয়েছে।
যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যে এনআরসি করতে দেওয়া হবে না বলে বারবার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজ্যের মানুষ যেন তাতে ভরসা করতে পারছেন না। রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করে মমতা বলেন, ‘আপনারা কেন চিন্তা করছেন? আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন। এত ভয় পাওয়ার কী আছে? আপনারা এ রাজ্যে বাস করেন। এ রাজ্যের নাগরিক। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে কে কী প্রচার করল, দয়া করে তার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মূল্যবান জীবন নষ্ট করবেন না। বিজেপিকে বলুন আগে ত্রিপুরায় এনআরসি করতে, দেখবেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর নামই বাদ যাবে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার বলে দিয়েছেন ওখানে তাঁরা এনআরসি মানবেন না। আমরা আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব। আমরা আধখানা রুটি খেলে আপনাদেরও আধখানা রুটি দেব।’ যাঁদের প্রয়োজনীয় নথিপত্র হারিয়ে গেছে, তাঁরা যেন বুদ্ধি করে স্থানীয় থানায় গিয়ে একটা এফআইআর করে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে বিজেপি অবশ্য নাগরিকপঞ্জি ইস্যুতে পুরোনো অবস্থানেই অনড় রয়েছে। এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘এনআরসি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। আমরা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনছি। এই বিল নিয়ে মানুষের সঙ্গে আলোচনা করব। এর আওতায় আমরা সব হিন্দুকে নাগরিকত্ব দেব।’
দিলীপ ঘোষ আরো বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নোটবন্দি, জিএসটি, তিন তালাক বিল, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ কোনো কিছুই আটকাতে পারেননি। এনআরসি যদি আমরা করি, তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটাও আটকাতে পারবেন না।’