পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চিতদের বড় অংশই মুসলমান : অমর্ত্য সেন

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মুসলিম উন্নয়ন নিয়ে যতই সাফল্যের দাবি করুক, বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা রয়েছেন অন্ধকারে। গতকাল রোববার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ওপর একটি বেসরকারি সমীক্ষার ভিত্তিতে অমর্ত্য সেন বলেন, পশ্চিমবঙ্গে যারা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে, যারা সবচেয়ে বেশি গরিব, তাদের বড় অংশই হলো মুসলমান।
অমর্ত্য সেন পরিচালিত সংস্থা প্রতীচী ইনস্টিটিউট, অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড-এর এক সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের দৈন্যের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। দুই দফায় সমীক্ষা হয়েছে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মুসলমান এখনো নিরক্ষর। এ ছাড়া ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিতে মুসলমান প্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৩-১৪ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তিন লাখ ২৪ হাজার ৪৬৭ জন। সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১৯ হাজার ৩৪২ জন। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলায়ও মুসলমানরা প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ১৮ শতাংশ মুসলমান এমন জায়গায় বসবাস করেন, যেখানে সাইকেল চালানোর মতো উপযোগী রাস্তা পর্যন্ত নেই। মাত্র ৯ শতাংশ মুসলমান বসবাস করেন পাকা রাস্তা এলাকায়। ৪ শতাংশ মুসলমান কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা এলাকায় বসবাস করেন। ৩৫ শতাংশ মুসলমানকে গ্রামবাংলার চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হয়। ১২ শতাংশ মুসলমানকে যেতে হয় প্রায় আট কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে।
জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের ৮১টি ব্লকের ৩২৫টি গ্রামে এবং ৩০টি পৌরসভার ৭৩টি ওয়ার্ডে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। মোট ৯৭ হাজার ১৭টি বাড়ি ঘুরে চার লাখ ৬৩ হাজার ৯০৪ জন মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে।
রোববার কলকাতায় সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপনের অনুষ্ঠানে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা শুধু বঞ্চনার শিকারই হচ্ছেন না। মুসলিমদের বেঁচে থাকা বা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করাও এই রাজ্যে যথেষ্ট সংকটময়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের উত্তরপ্রদেশ কিংবা কেরালা রাজ্যে মুসলিমদের বেঁচে থাকার অবস্থান তুল্যমূল্যভাবে অনেকটাই ভালো।
অমর্ত্য সেন আরো বলেন, মুসলমানদের সংকটময় অবস্থার সঠিক কারণ খুঁজতে ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হবে। মুসলিমদের সঙ্গে এই মাটির সম্পর্ক, সামাজিক বাধা, ব্যবসা করার সুযোগ, সরকারি সাহায্যের মতো অনেক বিষয় উঠে আসবে, যা খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘আসল সমস্যা হলো আমরা একে অপরকে ঠিকঠাক চিনি না। অপরিচয় থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। এই পরিচয় না থাকা থেকেই শুরু হয় অজ্ঞানতা। সেখান থেকেই আসে অবিশ্বাস। আর অবিশ্বাস থেকেই গড়ে ওঠে অসহিষ্ণুতা। যার ফলে সৃষ্টি হয় অশান্তি, দাঙ্গা। আর যতক্ষণ না দাঙ্গা হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি না। তাই অসহিষ্ণুতার শুরু যেখানে, সেই অপরিচয় দূর করতে হবে। আর সেটা করতে পারলেই আমরা সকলে এগিয়ে যেতে পারব।’