কোনো সরকার নয়, সাধারণ মানুষই সহায়

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অভিবাসীরা। কিন্তু এত কষ্টের পরও তাঁদের অনেককেই আবার ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সমুদ্রে। যে কয়জন আশ্রয় পাচ্ছেন, তাঁরাও সরকারি গুদামে কিংবা অনুন্নত পরিবেশে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের ভালো-মন্দ দেখভাল করতে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা গতানুগতিক। এমন অবস্থায় ওই দেশগুলোর সাধারণ লোকজনের করুণা কিংবা মানবিক বিবেচনাই এখন অভিবাসীদের সম্বল।
বার্তা সংস্থা এপির সরেজমিন প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত দুই সপ্তাহে মালয়েশিয়ার সাধারণ লোকজন চাঁদা তুলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অভিবাসীদের সাহায্য করেছেন। এতে বলা হয়, গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ায় জেলেরা তিনটি নৌকা থেকে উদ্ধার করে ৯০০ জনের জীবন বাঁচান। দেশটির সাধারণ লোকজন বাড়িতে তৈরি খাবার সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় পোশাক অভিবাসীদের সরবরাহ করেছেন।
এপি জানায়, বিভিন্ন দাতা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারে নির্যাতিত ও বাংলাদেশে দারিদ্র্যের শিকার হাজারো মানুষ এখনো আন্দামান সাগরে ভাসছে। কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর অভিযানে পাচারকারী ও নাবিকরা পালানোয় তাঁদের এ দশা হয়েছে। কিন্তু এ মানবিক সংকটের দুই সপ্তাহ হতে চললেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে না। অবাধ প্রবাহের ভয়ে কোনো অভিবাসীকেই জায়গা দিতে চাইছে না তারা। এ নিয়ে স্থানীয় সময় সোমবার থাইল্যান্ডের ‘দ্য ন্যাশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কার্টুনে দেখা যায়, রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থীদের বহনকারী একটি নৌকা তীরে ভিড়তে চাইছে। এটিকে লাথি দিয়ে সমুদ্রে ঠেলে দিচ্ছে উপকূলে থাকা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া এর চেয়ে ব্যতিক্রম।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ব্যাংককের দায়িত্বে থাকা নারী মুখপাত্র ভিভিয়ান তান বলেন, ‘আমরা একদিকে দেখছি, নৌকায় থাকা লোকজনকে নিয়ে সরকারগুলো সমালোচনায় ব্যস্ত। এ সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। অন্যদিকে এটা খুবই আশাব্যঞ্জক যে, ওই সব অঞ্চলের লোকজন নৌকায় থাকা লোকজনের প্রতি খুবই সদয় আচরণ করছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া অভিভূত হওয়ার মতো।
সরকারগুলোর উচিত এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা এবং যত দ্রুত সম্ভব আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করা।’
ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে মালয়েশিয়ার একজন মুফতি উল্লেখ করেন, এক বছর আগে দুর্ঘটনাকবলিত একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে দেশটির সরকার এখনো সমুদ্রে তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে। অথচ জীবন্ত লোকজন সমুদ্রে ভাসতে থাকলেও তাদের উদ্ধার করছে না।
আসরি জয়নাল আবেদিন নামে ওই মুফতি বলেন, ‘যারা এখনো বেঁচে আছে, আমরা তাদের সমুদ্রে মরতে দিচ্ছি। আমাদের মানবিকতা কোথায়?’
গত সপ্তাহে আশ্রয় পেতে মরিয়া, ক্ষুধার্ত অভিবাসীদের খাবার ও পানি দিয়ে সমুদ্রে ঠেলে দেয় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, ক্ষুধার্ত লোকজনের নৌকাগুলো ঠেলে সমুদ্রে পাঠানো ‘ভাসমান কফিন’ সমস্যা তৈরি করতে পারে। ওই ঘটনায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়ায়ও তীব্র সমালোচনা হয়। এরপর ১০ মে এক হাজার একশর বেশি যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা মালয়েশিয়ার তীরে ভেড়ে। এই অভিবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, পোশাক ও চিকিৎসাসেবা দিতে সমব্যথী নাগরিক ও স্থানীয় মুসলমানদের বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের মেয়ে ও সমাজকর্মী মেরিনা মাহাথির গত সপ্তাহে সমুদ্রে থাকা অভিবাসীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য পাঠানোর আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রকৃত উদ্বেগ এখনো যারা সমুদ্রে আছে তাদের জন্য। কারণ, বিষয়টি সত্যিকার অর্থে মানবিক সংকট। আমি মনে করি, এ ইস্যুতে আমরা হাত গুটিয়ে থাকতে পারি না।’