মোদি-ট্রাম্প বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে কী কথা হতে পারে?
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/12/nrendr_modi.jpg)
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মোদির এটি প্রথম মার্কিন সফর। মোদির এই সফরে দুই নেতার মধ্যে আলোচনায় গুরুত্ব পেতে পারে বাণিজ্যে মাসুল কম করা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের তেল ও প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনা, বেআইনি অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো, চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রসঙ্গ।
ভারত থেকে রওনা হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “বন্ধু ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়ে আছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। এই সফরে প্রযুক্তি, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করব। দুই দেশের মানুষ যাতে উপকৃত হন, আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করব।”
বাংলাদেশ নিয়ে কী আলোচনা হতে পারে?
মোদি-ট্রাম্প আলোচনায় নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসবে বলে মনে করেন পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
ওপি জিন্দল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব থাকবে বাণিজ্যের ওপরে। তবে বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আলোচনা হবে বলেই মনে হয়। তবে এখনই ট্রাম্প বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে কড়া লাইন নেবেন, পুরোপুরি ভারতকে সমর্থন করবেন, তা মনে হচ্ছে না।”
শ্রীরাধার মতে, “বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের মাথাব্যথা কম। তার অনেক বেশি মাথাব্যথা রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে। কিন্তু তিনি কাঁচা খেলোয়াড়ও নন। আর বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে। বাংলাদেশ থেকে যে দামে পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে যায়, সেটা অন্য কোনো দেশ দিতে পারবে না। আর যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থই দেখবে বলে আমার মনে হয়। তবে সাধারণভাবে তিনি ভারতের পাশে থাকবেন।”
প্রবীণ সাংবাদিক ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের এখনকার অবস্থা, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ভারত কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে সেটা মোদি জানাবেন।”
প্রণয় জানিয়েছেন, “প্রথমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ট্রাম্প দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে মোদির পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেন। ভারতের কথামতো চলার চেষ্টা করতেন। এখানেই ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে তার একটা পার্থক্য আছে। ডেমোক্র্যাটরা মাইক্রো ম্যানেজ করতে ভালোবাসে। তারা তাদের নীতি নিয়ে চলতে ভালোবাসে। ভারতের সেখানে সুবিধা হচ্ছে কি না, তা তারা দেখে না। কিন্তু ট্রাম্প অনেক বেশি করে ভারতের বিষয়টি মাথায় রাখেন।”
বাণিজ্য মাসুল কমানো
সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ট্রাম্পের দাবি মেনে নিয়ে ভারত বাণিজ্য মাসুল আরও কমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে নামতে চাইছে না।
ভারত ইলেকট্রনিক্স, চিকিৎসা সামগ্রী, রাসায়নিক, বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কম করতে পারে।
ট্রাম্পের আর্থিক পরামর্শদাতা কেভিন হ্যাসেট বলেছেন, ভারত বাণিজ্য মাসুল অনেকটাই বাড়িয়ে রেখেছে। যখন মোদি ও ট্রাম্প কথা বলবেন, তখন তারা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারে কথা বলবেন।
ভারত একাধিক জিনিসের ওপর বাণিজ্য মাসুল কমাতে পারে। কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়ন সেস তুলে দেওয়া নিয়েও ভারতের ওপর চাপ আছে।
মোদি কী করতে পারেন?
ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তেল ও গ্যাস কিনতে চায়। ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলো বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনতে ইচ্ছুক।
সংবাদসংস্থা এএনআইকে ইউএসআইএসপিএফের প্রেসিডেন্ট ও সিইও মুকেশ আঘি বলেছেন, “বাণিজ্য নিয়ে দুই দেশ কী সিদ্ধান্তে আসে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তর, আর্থিক বিষয়গুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
দ্য টেলিগ্রাফের দিল্লির সাবেক বিজনেস এডিটর জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, “কয়েকদিন আগে যে বাজেট পেশ করা হয়েছে, তাতে অনেকগুলো জিনিসে মাসুলের হার অনেকটা কমানো হয়েছে। অনেকগুলো জীবনদায়ী ওষুধের ওপর থেকে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর ফলে মার্কিন ওষুধ তৈরির সংস্থা লাভবান হবে। ইলেকট্রিক গাড়ি ও ফোনের ব্যাটারির ওপর থেকেও কাস্টমস শুল্ক পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর ফলে হার্লি ডেভিডসনের মোটরসাইকেল ভারতে কম দামে পাওয়ার কথা।”
প্রণয় শর্মা বলেছেন, “ট্রাম্প যেভাবে শুল্ক কমানোর বিষয়টি বলেছেন, তা হলো তার ‘ওপেনিং বার্গেনিং লাইন’। শুল্কটা কমবে, তা আমরা পরে বুঝতে পারব। ট্রাম্প খালি নিজের মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তারা চায়, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি জিনিস কিনি।”
প্রতিরক্ষা নিয়ে
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফ৩৫ যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায়। তারা যুদ্ধে প্রয়োজনীয় গাড়ি কিনতে ও তা দেশে বানাতে আগ্রহী। এছাড়া কিছু অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনতে চায় ভারত।
জয়ন্ত বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই ভারতে প্রতিরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করতে আগ্রহী। ট্রাম্পও সেটাই চান। তবে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকেও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র কেনে। এই বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্র তুলতে পারে।”
ভিসা নিয়ে জটিলতা
এইচওয়ানবি ভিসা যাতে আগের মতো চালু থাকে, সেই বিষয়টি ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হাজার হাজার ভারতীয় পেশাদার এই ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করতে যান।
ট্রাম্প এই ভিসা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আইনি পথে মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে এসে কাজ করলে তার আপত্তি নেই। তবে মোদি-ট্রাম্প বৈঠকে এই ভিসা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
বেআইনি অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো
কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০৪ জন বেআইনি অভিবাসীকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাদের পাঠানো হয়েছে সামরিক বিমানে এবং পুরুষদের হাতকড়া ও পায়ে শিকল পরিয়ে। এরপর বিরোধী নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগে থেকে নেওয়া নির্দিষ্ট নীতি আছে। তারা তা অনুসরণ করছে।
প্রণয় শর্মা জানিয়েছেন, “ভারত ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা বেআইনি অভিবাসীদের গ্রহণ করবে। তবে যেভাবে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাতে মানবিকতা লঙ্ঘিত হয়েছে। তারা কেউ অপরাধী নন। তাদের এইভাবে অপমান করাটা মেনে নেওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম থাকতেই পারে। কিন্তু মানবিক মর্যাদার একটা বিষয়ও আছে।”
প্রণয় মনে করছেন, “ট্রাম্প আসলে এটা দেখানোর চেষ্টা করছেন, তিনি শুধু মেক্সিকো বা অন্য দেশের অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছেন তাই নয়, একইভাবে বন্ধু দেশ ভারতের বেআইনি অভিবাসীদেরও ফেরত পাঠাচ্ছেন। তবে অতীতে দেখা গেছে, ট্রাম্প কোর্স কারেকশন করেন। এক্ষেত্রে করবেন কিনা সেটা দেখার বিষয়।”