বিরল কচ্ছপের জীবন রক্ষায় রাতভর এলাকাবাসীর পাহারা

ভারতের বেঙ্গালুরুরের এক কিশোর যাজুর কার্তিক (১১)। এ বয়সে গ্রীষ্মের ছুটিতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আনন্দে দিন কাটানোর কথা থাকলেও সে রাত জেগে চেন্নাই সমুদ্রতীরে অলিভ টারটল জাতের একটি কচ্ছপ পাহারা দেয়, যেন মানুষ কিংবা কুকুরের উপদ্রবে বিপন্ন এই প্রাণীটি একেবারে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে না যায়।
মানুষের হাত ধরেই আধুনিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে, পৃথিবীর নানামুখী দুর্যোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্যও আবার তারাই দায়ী। বলা চলে, মানুষ রক্ষক ও ভক্ষক উভয়ই বটে। মানুষের নানাবিধ কার্যকলাপে প্রাণিকুলের জীবন যেমন সংকটে পড়ে, তেমনিই প্রাণীদের জীবন রক্ষায় এগিয়েও আসে অনেক মানুষ। তাদেরই একজন যাজুর কার্তিক।
ভারতের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত চেন্নাই। এই শহরের উপকূলে ডিম পাড়তে আসে বিপন্নপ্রায় অলিভ টারটল জাতের কচ্ছপ। লোকবহুল এ এলাকাটিতে কচ্ছপের ডিম-বাচ্চার জীবনে নানা রকম ঝুঁকি থাকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকে এই ডিম চুরি করে খেয়ে ফেলেন, কখনো আবার মাছ ধরার জালেও ধরা পড়ে কচ্ছপ। মানুষ বাদে স্থানীয় কুকুরও ডিম বা বাচ্চাগুলো পেলে খেয়ে ফেলে। এভাবে প্রতি বছর কয়েক হাজার কচ্ছপ মারা যায় শুধু চেন্নাইতেই।
এসব ঝুঁকি থেকে কচ্ছপ বাঁচাতে প্রায় চার দশক ধরে রাত জেগে পাহারা দিয়ে আসছেন চেন্নাইয়ের বাসিন্দারা। অন্যান্য জায়গা থেকেও অনেক স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয়দের এ কাজে সহায়তা করতে আসেন।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ বছর প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার ডিম সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। চেন্নাইয়ের মানুষের এই কার্যক্রম মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সহাবস্থানের ক্ষেত্রে অনন্য এক উদাহরণ।
স্থানীয়রা জানান, ডিসেম্বর-এপ্রিল পর্যন্ত অলিভ টারটলের ডিম পাড়ার সময়। এ সময় চাঁদের আলোতে ভেসে ভেসে উপকূলে ডিম পাড়তে আসে সারি সারি কচ্ছপ। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ৬০ দিনের মতো। পুরো সময়টিতে ডিম এবং ছোট কচ্ছপ ছানা রক্ষা এক রকমের দক্ষযজ্ঞ। মধ্যরাত থেকে পাহারা শুরু করেন তারা। উপকূল ঘুরে স্থানীয়রা কচ্ছপের পায়ের ছাপ এবং কিছুটা উঁচু বালির ডিবি খুঁজতে থাকেন। সাধারণত এরই মধ্যে কচ্ছপের ডিম পাওয়া যায়।
প্রাপ্ত ডিম সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে একই গভীরতায় পুঁতে রাখেন পাহারারত স্থানীয় মানুষজন। কচ্ছপের লিঙ্গ নির্ধারণে তাপমাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান গবেষকরা। তাদের তথ্য মতে, সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে পুরুষ কচ্ছপ জন্মের হার হ্রাস পাচ্ছে।
উপকূলের কচ্ছপগুলো রক্ষায় কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী মেলভিন বার্তাসংস্থা এপিকে জানান, উপকূলের প্রায় ৩০ কিলোমিটারের মতো জায়গা ঘুরে নিরীক্ষা চালায় পাহারারত দলগুলো। কোথায় ডিম খুঁজে পেলে বালি থেকে তুলে একটি কাপড়ের মধ্যে পেঁচিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান মেলভিন ও তার দলের সদস্যরা।
স্বেচ্ছাসেবী কার্তিক বলেন, শুধু কচ্ছপগুলোকে সহায়তা করতেই আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে চেন্নাই আসি। এখানে হাজারে মাত্র একটি কচ্ছপ প্রাণে রক্ষা পায়। প্রাচীন এই প্রাণীগুলোর রক্ষা করা খুবই দরকার, নতুবা এক সময় অলিভ টারটল পৃথিবী থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।