ইসরায়েলিদের বর্ণনায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভয়াবহতা!

ইসরায়েলের বাড়িঘর ও অ্যাপার্টমেন্টে শুক্রবার (১৩ জুন) রাতজুড়ে বেশ কয়েকটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে, তিনজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। খবর টাইমস অব ইসরায়েলের।
ইরানের সামরিক নেতৃত্ব এবং পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরান বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এ সময় সতর্কীকরণ সাইরেনের শব্দে লাখ লাখ ইসরায়েলি নিরাপদ কক্ষ এবং বোমা থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায়। যদিও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্রই প্রতিহত করা হয়েছে, তবে বেশ কয়েকটি বড় বিস্ফোরকবাহী ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব, রামাত গান ও রিশন লেজিওনের বাড়িগুলোতে আঘাত করেছে।
শুক্রবার রাতে তেল আবিবের একটি বহুতল ভবনের বাসিন্দা তালি হোরেশ নামের এক নারী নিউজ সাইট ওয়াইনেটকে বলেন, ‘আমরা দরজা বন্ধ করে দিলাম, কম্পিউটারের মাধ্যমে খবর দেখতে শুরু করলাম, আর হঠাৎ এত জোরে একটা শব্দ হলো যে পুরো ভবন কেঁপে উঠল।’
‘কয়েক মিনিট পরে আমরা দরজা খুললাম, কারণ ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্রটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরো বসারঘর ধোঁয়ায় ভরে গেল এবং আমরা নিরাপদ কক্ষে ঢুকে গেলাম’, যোগ করেন তালি হোরেশ।
সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট জানিয়েছে, উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছানোর আগে হোরেশ এবং তার পরিবার প্রায় দুই ঘণ্টা নিরাপদ কক্ষে অবস্থান করেন।
তালি হোরেশ আরও বলেন, ‘বাড়ির নিচের তলায় ব্যাপক ধ্বংসস্তূপ ছিল। পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, দরজা একপাশে ভেঙে গেছে, বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। লবিটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
পরে উদ্ধারকারী দলের শত শত আইডিএফ হোম ফ্রন্ট কমান্ডের সৈন্য, দমকলকর্মী, পুলিশ সদস্য, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও প্রশিক্ষিত কুকুর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে নিশ্চিত হয় ভবনে কেউ আটকা পড়ে নেই।

হোম ফ্রন্টের তেল আবিব কমান্ডের নেতৃত্ব দেন কর্নেল (রিজার্ভ) মাইকেল ডেভিড। তিনি ওয়াইনেটকে বলেন, তার বাহিনীকে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয় এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। তবে তিনি বলেন, ‘এটি এমন একটি বিশাল ঘটনা, যা আমরা অতীতে দেখিনি।’
মাইকেল ডেভিড বলেন, ‘আমরা ভবনটিতে বসবাসকারী মানুষের ছবি সংগ্রহ করি, যাতে কেউ নিখোঁজ বা আটকা পড়ে আছে কিনা তা জানা যায়। এটি একটি কষ্টসাধ্য কাজ যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নিতে পারে, বিশেষ করে যখন আমরা অনেক উঁচু ভবনের কথা বলি, সেখানে শত শত বাসিন্দা থাকে। আমরা যতক্ষণ না নিশ্চিত হই যে, আমরা কোনো বাসিন্দাকে ফেলে যাচ্ছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেখান থেকে সরে যাই না।’
ইরানের মহুর্মুহু ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঝাঁকের আঘাতে তেল আবিব এবং নিকটবর্তী রামাত গানের বেশ কয়েকটি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব এলাকায় মোট ৬৩ জন আহত হয়, যার মধ্যে একজন নারী গুরুতর আহত হন এবং পরে মারা যান।
শনিবার ভোরে তেল আবিবের কাছে রিশন লেজিওনের একটি আবাসিক এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্রের আরেকটি ঝাঁক আঘাত হানে। এতে ৭৩ বছর বয়সী ইসরায়েল অ্যালোনি নামে একজন পুরুষ এবং আরেকজন নারী নিহত হন এবং কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষের মধ্যে তিন মাসের এক শিশুও রয়েছে। ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ সার্ভিসের ক্যাপ্টেন ইদান চেন সংবাদমাধ্যম ওয়ালাকে বলেন, ‘আমি তাকে আমার কোলে টেনে নিলাম এবং তারপর প্রথম যে পুলিশ অফিসারকে দেখলাম তার হাতে দিলাম, এবং তারপর পরিবারের অন্য সব সদস্যদের বের করতে শুরু করলাম।’
‘আমরা যখন এটি করছিলাম, তখন উপরে এবং পাশের বাড়িতে লোকজন আটকা পড়েছিল। বিপরীত দিকে আগুন জ্বলছিল এবং আমি সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছি’, বলেন ইদান চেন। শিশুটি সামান্য আহত হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
এলাকাটির বাসিন্দা আভি গ্যাটেনিও চ্যানেল ১২-কে বলেন, ‘আমি আর বাচ্চারা ঘুমাচ্ছিলাম, আমার স্ত্রী বিদেশে। সাইরেন বাজতেই আমরা নিরাপদ কক্ষে ছুটে গেলাম। পাঁচ মিনিট পরে আমরা একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলাম।’ এরপর বাইরে গিয়ে দেখেন, তার প্রতিবেশীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং তিনি এক বৃদ্ধ দম্পতিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছেন বলে জানান।
‘এরপরই, আমি বাচ্চাদের কাছে ফিরে যাই, কারণ তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল’, বলেন গ্যাটেনিও। ‘ঈশ্বরের কৃপায়, আমাদের কিছুই হয়নি, আমাদের একটা আঁচড়ও লাগেনি’, যোগ করেন তিনি।
মাটিতে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরোগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে গ্যাটেনিও বলেন, ‘এরকম কাঁচের টুকরো একটি শিশুর ধমনীতে ঢুকে গেলে তার মৃত্যু হতে পারে।’
ইসরায়েল প্রথমবারের মতো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর একদিনেরও কম সময়ের মধ্যে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দেশটি। ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানীসহ বেশ কয়েকজন নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হয়। ইরানে ইসরায়েলি আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
ইসরায়েল ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়। তবে ইসরায়েলকে ধ্বংস করার শপথ নেওয়া ইরানের নেতারা প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু ৬০ শতাংশ হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে দেশটি। এই হার বেসামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি এবং অস্ত্র-গ্রেড থেকে সামান্য কম।