সোমেন চন্দের জীবন ও সাহিত্যভাবনা

একটা মানুষের জীবনের শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাকে বলে প্রাইমিংটা (এর লাগসই বাংলা প্রতিশব্দ পেলাম না বলে এটাই রাখতে হলো ) কেমন হলো তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী জীবনে সে কোন দিকে যাবে। সোমেন চন্দ যে একটা প্রগতিশীল পরিবেশের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছেন তা তার জীবনী থেকেই জানা যায়। আর সেই পরিবেশই তাকে শ্রমজীবী শ্রেণির রাজনীতি এবং সেই রাজনীতির পরিপূরক সাহিত্যের দিকে আকর্ষণ জাগায়। কিন্তু সোমেন চন্দের বেলায় একটা কথা বলতে হয় তিনি রাজনীতির সাথে সাহিত্যকে গুলিয়ে ফেলেননি কখনোই। দুটোর জন্যই তার আলাদা করে অনুরক্তি ছিল। তবে কোনটা তার এক নম্বর মুখচ্ছবি তা আজ বলা কঠিন। যদিও তিনি আত্মউৎসর্গ করেছেন রাজনীতির জন্যই সোমেন চন্দের প্রায় বাইশ বছরের জীবনে দুটো অধ্যায়। একটা রাজনৈতিক অন্যটি সাহিত্য। এর মধ্যে কোনটা তার জীবনে প্রধান সে বিষয় এখন অবান্তর।
রাজনৈতিক বিষয়টা তাঁকে কতখানি প্রসারিত করেছিল তা তাঁর জীবন সম্বন্ধে পড়লেই জানা যায়। অবশ্যই তিনি সাম্যবাদের জন্য জীবনপাত করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সাফল্য তাঁর কতখানি আসত তা আজ আর বলা যায় না। তবে রাজনীতির পরিপূরক বিষয় হিসেবে তিনি যে সাহিত্য রচনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন সেটা এইটুকু বয়সেই তাঁর করায়ত্ত হয়েছিল। রাজনীতি সমষ্টিগত কাজ। সাহিত্য একান্তই ব্যক্তিগত। যদিও রচিত হওয়ার বা বলা যায় প্রকাশ হওয়ার পর সেটা আর মোটেও ব্যক্তিগত থাকে না। নিশ্চয়ই সেটা কাঙ্ক্ষিতও নয়। এখানে সোমেন চন্দ যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতি করেছেন সেই একই আদর্শ তিনি লালন করেছেন গল্প উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে। জীবনের অল্প পরিসরে তিনি যতটুকু সাহিত্য রচনা করতে পেরেছেন তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
১৯২০ সালের ২৪ মে সোমেন চন্দ জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথের তখন নোবেল পাওয়া হয়ে গেছে। তার মানে বাংলা সাহিত্য এরইমধ্যে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে পোক্ত একটা আসন আদায় করে নিয়েছে। আর নোবেল প্রাপ্তি থেকে সোমেন চন্দের জন্মের সময়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে অনেকে পিছিয়ে পড়ার দলে ফেলতে চেয়েছেন। সজনীকান্ত তাঁর বিভিন্ন লেখাকে নিজের মত করে সমালোচনার খোঁচায় বিদ্ধ করে চলেছেন। পঞ্চকবিও আধুনিক সাহিত্য রচনার জন্য পুরানো হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে এক পাশে ফেলে দিতে চান প্রায়। যদিও পরবর্তীকালে প্রায় সবাই রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক বলেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। কথাগুলো বলার কারণ ঠিক এই সময়ে জন্ম নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের এরকম পক্ষ বিপক্ষ বলয়ের চর্চার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন সোমেন চন্দ।
সময়টা সোমেন চন্দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে তাঁর জীবনের পরিধি প্রায় ঐটুকুই। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে তৈরি করা। নিজের শিক্ষার তরীকে সঠিক পথে পরিচলনা করা। এরপর আপন অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে সৃষ্টিকে বাংলা সাহিত্যের মত সমৃদ্ধ মঞ্চে সাফল্যের সাথে উপস্থাপন করা। তাঁর এই প্রতিভা বিকাশে পরিবারের অবস্থান কম গুরুত্বপূর্ণ না। তাঁর সৎ মা সরযু বিশ্বাস সোমেনকে পেয়েছেন পাঁচ বছর বয়স থেকে। সরযুদেবীর পরিবার ছিল রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। সোমেন চন্দ মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন বেড়ে ওঠার রসদ। নতুন মা তাকে আপন পুত্রের মতই বড় করে তুলেছেন। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল সোমেন্দ্রকুমার চন্দ। দুর্ভাগ্য তার জীবনের শুরুতেই। তিন চার বছর বয়সে মা হিরণবালা কলেরা রোগে মারা যান। বাবা নরেন্দ্রকুমার চন্দ পরে সরযুদেবীকে বিয়ে করেন।
সরযু বিশ্বাসের বাবা ছিলেন টঙ্গির বউর গ্রামের ডা. শরৎচন্দ্র বিশ্বাস। সরযু বিশ্বাসের মামারা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আর এখান থেকেই সরযু বিশ্বাসের রাজনৈতিক সচেতনতা। আর এই মায়ের হাতেই সোমেন চন্দের রাজনৈতিক পাঠ এবং লেখাপড়ার পাঠ শুরু। বাবাও ছিলেন সমসাময়িক রাজনীতি সচেতন। বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন রাজনীতির আর সংস্কৃতির। মা সরযুদেবী ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। সে সময়ের প্রায় সব ধরণের বই তিনি সংগ্রহ করে পড়তেন। মায়ের এই বই পড়ার অভ্যাস সোমেন চন্দের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি মায়ের পড়া বইগুলো পড়তে থাকেন। এই সাথে চলছিল তাঁর রাজনৈতিক পাঠ। একটা ক্রান্তিকালের ভিতর দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর জীবন ভাবনা, সমাজ সচেতনতা অন্য একটা মাত্রা পায় সমসাময়িক জাতীয় রাজনীতি এবং বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে।
কেবল ভারতের স্বাধীনতা না, নিগৃহীত মানুষের মুক্তির বিষয়টাও তাঁর মনে ঢুকে যেতে থাকে। আর এই সব সম্বন্ধে জানার জন্য তাঁর পাঠের অভ্যাসও পালটিয়ে যায়। এসব বিষয়ে আগ্রহ মেটাতে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত লেখকদের বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করেন। বাড়তে থাকে তাঁর জানার পরিধি এবং এইভাবে নিজেকে করে তোলেন আরও সমৃদ্ধ। একজন লেখক একক কোন সত্ত্বা না। তাঁকে কাল পরিভ্রমণ করতে হয়। সমাজকে আত্মস্থ করতে হয়। তার সাথে ইতিহাসকে মস্তিষ্কে ধারণ করে যে নির্যাস তিনি রেখে যান সেটাই পরিপূর্ণ সাহিত্য। সোমেন চন্দকে ভাবলে অবাক হতে হয়। তিনি কেবলই একজন কিশোর। ঐ বয়সে তাঁর জ্ঞানের পরিধি কতটুকু হওয়ার কথা। সোমেন চন্দের ডাক নাম ছিল শম্ভু। আর তাই বোধহয় তাঁরও ছিল ত্রিনয়ন। সাধারণ দৃষ্টিতে যতটুকু গোচর হয় তিন দেখতে পেতেন আরও বেশি। আর সেই কারণে সোমেন চন্দ পাঠ করলে আজও এত আধুনিক মনে হয়। তার গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয় সমসাময়িক সমাজ। ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে চলছে সংগ্রাম। আর সোমেন চন্দের মন সেই সাথে বিক্ষিপ্ত চারদিকের অসহায় মানুষের দুর্দশা দেখে। মধ্যবিত্ত সমাজের অবক্ষয় তাকে নাড়া দেয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য তার মনে প্রশ্ন জাগায়। অল্পকিছু কালের মধ্যেই মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাভাবে মানুষ পাগল প্রায়। এই সব বিষয়ই উঠে এসেছে তার গল্পে। আশ্চর্যের বিষয় তিনি যখন তাঁর কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক প্লাটফর্মটি খুঁজে পান তখন বোঝেন কিভাবে এই সমস্যার সমাধাণ করতে হবে। রাজনৈতিক পদচারণার সাথে সাহিত্য রচনা চলতে থাকে। তিনি সাহিত্য এবং রাজনীতিকে অভিন্ন ব্রত হিসাবে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার গল্পে তিনি কোন দিনই রাজনৈতিক বুলি কপচাননি। তবে তার গল্পে দেখা যায় সাম্যবাদের শিল্পিত প্রকাশ।
একটা বিষয় বলতে হয় সেই সময় বাংলার মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ থাকত শহর বা শহরতলীতে। বাকি সবাই তখন গ্রামবাসী। সেই তুলনায় তাঁর গ্রাম প্রেক্ষাপটের গল্প কম। হতে পারে সেটা এই জন্য যে তিনি যে আন্দোলনে জড়িত যা তাকে সব সময় তাড়া করে ফিরত তা সাধারণত নগরকেন্দ্রিক। এই প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন রাখা যেতে পারে। তার রাজনৈতিক একটা আদর্শ ছিল বটে কিন্তু তার পরিপূর্ণতা কতখানি ছিল সেটা ভাবার বিষয়। তবে সেই প্রশ্নটা কেবলই তার জন্য না, সেই সময়ের কমিউনিস্ট নেতাদের জন্যও। রাজনৈতিক বা সামাজিক ইতিহাস বোঝার জন্য আর্থিক পটভূমি জানা প্রয়োজন। সমাজতন্ত্রের নেতৃত্ব তখন মধ্যবিত্তের হাতে। এই মধ্যবিত্তের সংখ্যা দেশের কৃষক শ্রমিকের তুলনায় নগন্য। অথচ বিশাল কৃষক শ্রেণীর যদি বিপ্লবের সাথে একাত্মতা না থাকে তাহলে সেই বিপ্লব প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। সে সময় অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ কোটির মত। যার মধ্যে কৃষকের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এই কৃষকদের জন্য চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ একর। কৃষক পরিবার মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল দুই একরের নিচে। যা দিয়ে একটা পরিবারের ভরণপোষণ করা ছিল কষ্টকর। আরও যেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল কৃষিজীবিদের ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক চাষীতে পরিণত হওয়া। অভাবের তাড়নায় তাদের জমি ক্রমে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। আর এই জমির মালিক হচ্ছিল পেশাদারি বাঙালি মধ্যবিত্ত। এদের মধ্যে ছিল উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক। আর এরা কোনভাবেই কৃষির উন্নতির জন্য কিছু করার চিন্তা করেন নি। কেবল জমি বর্গা দিয়ে এ থেকে মুনাফা করতে চেয়েছে।
এখানে উল্লেখ করতে হয় ভারতের অন্যান্য প্রদেশে যেখানে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ জমি সেচের আওতায় ছিল সেখানে বাংলায় ছিল মাত্র সাত শতাংশ। অর্থাৎ বাংলা তুলনমূলক অবহেলিত ছিল। পরে যখন জমির মালিক হয়ে দাঁড়ায় অচাষী তখন সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এরা কেউই কৃষির উন্নয়নে কোন রকম কার্যকরী ভূমিকা রাখে নি। তার মানে কৃষকের শত্রু হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাভোগি মধ্যবিত্ত। তাহলে মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতেই পারে। আর সেই জন্য যে প্রশ্নটা বারবারই ওঠে, এই নেতৃবৃন্দের কত ভাগ সাধারণ কৃষকের সাথে, সাধারণ শ্রমিকের সাথে একাত্ম হতে পারতেন? আর যাদের জন্য বিপ্লব, যদি তাদের সমব্যথী না হওয়া যায় তাহলে সেই বিপ্লবের সার্থকতা কতখানি হতে পারে তা ভাবার বিষয়। এই বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায় বলা যায় যে বাম রাজনীতির সফলতা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিচার করলে হতাশ হওয়ার মতই। এখানে একটু অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলতে হয় শুধু তৎকালীন প্রায়গিক বিষয় ছাড়াও মূল সমাজতন্ত্রের তত্ত্বগুলোও যে নতুন করে যাচাই বাছাই করার প্রয়োজন তা আজকের দিনে অনেকেই স্বীকার করবে। অতএব তার পিছনের মানুষদের এই সব নিয়ে যা কিছু সৃষ্টি তার প্রতি দ্বিধা থেকেই যায়। এত কিছুর পরও বলা যায় প্রগতিশীল আদর্শের প্রতি সত্যনিষ্ঠতার জন্য শ্রদ্ধা জানাতে হয়। অন্তত কিছু সমাজতান্ত্রিক নেতার মত সোমেন চন্দের আদর্শগত সততাকে মেনে নিতেই হয়। আর সেই কারণে তার সৃষ্ট সাহিত্যকেও আমরা গ্রহণ করি সমাদরে।
সাহিত্য পাঠের সাথে সাথে তাঁর রাজনৈতিক পাঠও চলতে থাকে। দক্ষিণ মৈশুন্ডির ৪৭ নম্বর লালমোহন স্ট্রিটের বাসায় থাকার সময় সোমেনের বয়স ছিল সতের। সালটা ছিল ১৯৩৭। আন্দামান জেলে ১৯৩৪ সালে সংগঠিত কমিউনিস্ট সংহতি সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠনের। তার প্রেক্ষিতে সতীশ পাকড়াশীর নেতৃত্বে ঢাকার কমিউনিস্টরা পার্টি সংগঠন আরম্ভ করে। এরই সূত্র ধরে ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে জোড়পুল লেনে ‘প্রগতি পাঠাগার’ নামে কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের দ্বারা স্থাপিত হয় একটা পাঠাগার। এই পাঠাগারের অন্তরালে চলতো ‘কমিউনিস্ট পাঠচক্র’। আর এই পাঠচক্রের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের মার্কসবাদ - লেনিনবাদের শিক্ষা দেওয়া হত। সোমেন চন্দ এখানে এসে পেয়ে যান সাম্যবাদের মানুষজনদের। যারা লড়াই করছে নিপিড়ীত মানুষের মুক্তির জন্য। শ্রেনীবৈষম্য দূর করার জন্য। সোমেন চন্দ তার এতদিনের জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পান। পেয়ে যান মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের দিশা। আরও পান সমাজের বৈষম্য দূর করার পথ। তিনি এঁদের দ্বারা বাম রাজনীতিতে দীক্ষিত হন। আর তার রাজনীতিতে আগ্রহ, একাগ্রতার কারণে সতের বছর বয়সে পার্টির সদস্য হওয়ার সুযোগও পেয়ে যান। বাম রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর ব্যাপক পড়াশুনা এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তাকে পার্টির একজন একনিষ্ঠ দক্ষ কর্মী হিসাবে প্রমাণ করে। আর সেই জন্য মাত্র বিশ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের পরিচালনার ভার দেওয়া হয় সোমেন চন্দকে।
সোমেন ছিলেন যেমন মেধাবী তেমনি পরিশ্রমী। শ্রমিকদের সচেতন করে গড়ে তুলতে দিনের পর দিন তাদের সাথে আলোচনা করা। তাদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা। তারপর আবার তাদের ন্যায্য দাবীগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসা। সবই তিনি করেছেন নিজের পড়াশোনা ও লেখালিখির পাশাপাশি। তার ক্ষুরধার বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনার সময়। রেল কর্তৃপক্ষের জাঁদরেল সব কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের দাবী আদায়ে টক্কর দেয়া যার তার কাজ না। সোমেন চন্দ প্রায় কিশোর বয়সে সেই কাজই করেছেন। সোমেন চন্দ তাঁর প্রতিভার আরও কী কী স্বাক্ষর রাখতে পারতেন তা আমরা বলতে পারি না। কিন্তু তার ব্যাপক সম্ভাবনা যে ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু এরই মধ্যে নেমে আসে সেই ঘোর অমানিষাময় দিনটি। শ্রমিকদের একটা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার সময় সন্ত্রাসীদের হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন তিনি। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ দিনটি চিরদিনের জন্য আমাদের কাছে শোকের হয়ে রইল।
সোমেন চন্দের বাইশ বছরের জীবনে রচনা করেছেন ২৮টি গল্প, ২ টি নাটক, একটা অসমাপ্ত উপন্যাস আর কিছু কবিতা। স্বাভাবিক ভাবেই সোমেনকে পাঠ করতে হলে গল্প গুলোকেই বিচারে নিতে হয়। জানা থাকলেও আবার স্মরণ করতে হয় তার জীবনের আদর্শ ছিল সমাজতন্ত্র। তার সাহিত্য রচনাও এই আদর্শকে বাস্তবায়নের আরেকটি হাতিয়ার। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মূলে ছিল মধ্যবিত্ত সমাজ। সোমেন চন্দের গ্রামীণ জীবন সম্বন্ধে জানাশোনা থাকলেও তিনি মূলত মধ্যবিত্তের জীবনের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, মধ্যবিত্তের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ নিয়েই লিখেছেন। তার স্বাক্ষর গল্প হিসাবে চিহ্নিত ‘ইঁদুর’।
দেশের ক্রান্তিকালে সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যান্য গল্পের মধ্যে যেমন সংকেত, দাঙ্গা, উৎসব সব গুলোতেই সময় এবং প্রেক্ষাপট অভিন্ন। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন, দারিদ্রের সাথে লড়াই, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য বিপ্লবের প্রস্তুতি, তা ছাড়া এ সবের ধারক বাহক হিসাবে যাদের মহিমান্বিত করা হয় সেই মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন সব কিছুই স্থান পেয়েছে তার গল্পে। ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে তখন অনেকেই সচেষ্ট। প্রগতিবাদীদের পরিকল্পনায় স্বাধীনতা আসবে জাতিবর্ণভেদকে দূরে হটিয়ে, শ্রেনীবিভাজন মুক্ত একটা নতুন দেশ নিয়ে। যার জন্য মধ্যবিত্ত সমাজ নেতৃত্ব দিচ্ছিল বিপ্লবের জন্য । কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী আদর্শগত ভাবে সততার মধ্যে দিয়ে ত্যাগের উদাহরণ সৃষ্টি করে যে জীবন যাপনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতো তা প্রায় অবাস্তব। একটা সময় ছিল সারা বিশ্ব জুড়েই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মধ্যবিত্তিক মূল্যবোধ যা তাকে মহিমান্বিত করার মত শক্তি রাখতো। ক্রমে শহুরে জীবন যাপনের জটিলতা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে এই মূল্যবোধ ক্ষয়িষ্ণুতার পথে এগিয়ে যায়। আর এই ধরণের দ্বন্দ নিয়েই রচিত হয় সোমেন চন্দের গল্প। যখন পরিবর্তনের দরকার তখন তার ব্যপকতার সামনে কুঁকড়ে যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী। শুধু তাই না নিজেকে সান্তনা দিতে সেই সব মধ্যবিত্ত আদর্শকে রোমান্টিক চিন্তার মধ্যে দিয়ে জিইয়ে রাখে।
বিপ্লবের জন্য যখন সব কিছু ভেঙে নতুন করে সব গড়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তখন মধ্যবিত্ত নিজেকে আড়াল করেছে সেই রোমান্টিক স্বপ্নের আড়ালে। এই সমস্যাকে সকলের সামনে উন্মোচন করেন সোমেন। তিনি দেখান কিভাবে এই ঠুনকো মূল্যবোধকে ভিতর থেকে ইঁদুরের মত কুড়ে কুড়ে শেষ করে দিচ্ছে। স্বাধীনতা বা সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের সমস্যা আরও ছিল বর্ণবিভেদ বা শ্রেণীবিভাজনের মত জটিল বিষয় নিয়ে। মধ্যবিত্ত যতই আদর্শের কথা বলুক বর্ণ, ধর্ম বা শ্রেণী বিভাজনের সংস্কার থেকে সহজে মুক্ত হতে পারে না। আবার এ সবের মূলে যে অর্থনৈতিক মুক্তি তা নিয়েও কোন কার্যকর সাহসী পদক্ষেপ দেয়ার ক্ষমতাও তার নেই। পুরো সময় ধরে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ ছাড়া গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি বিষয়ে কিছুই ঘটেনি। তাছাড়া তখন ভারতবর্ষের মানুষ স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর এই স্বাধীনতার আন্দোলনের পথও কিন্তু সরল নয়। এর জন্য ছিল নানা মেরুকরণ, নানা মতবাদ, সর্বোপরি নানা ষড়যন্ত্র। অর্থাৎ প্রায় একটা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির জন্য সমাজতন্ত্র এনে দেয়ার জন্য মোটেও অনুকূল পরিবেশ সেটা ছিল না।
স্বাধীনতার সময় হতাশাজনক পরিস্থিতি বোঝার জন্য বলা যায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আলো নেই’ উপন্যাসের কথা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে ছিল রাজনৈতিক হঠকারিতা, মানুষের মধ্যে ধর্মবৈষম্য আর সেই সাথে চিরাচরিত শ্রেণী বৈষম্য তো ছিলই। উপন্যাস জুড়ে স্বাধীনতা আনার নানা আয়োজনের উল্লেখ আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতে হতাশার সুরটাই বাজে। অবশ্য এর নামকরণ দিয়েই সেটা অনুধাবন করা যায়। সোমেন চন্দ এইসব মানুষদের নিয়েই লিখেছেন। তিনি হয়তো এর অন্ধকার দিকটা দেখেছেন কিন্তু তারপরও আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে চেয়েছেন। যদিও সকল পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটা প্রতিকূল পরিবেশ। আর আজ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অনুকূলে আনার প্রকৃত আয়োজন হয়নি। যার জন্য বিপ্লব বার বার হোঁচট খেয়েছে। ভারত স্বাধীনতা নিয়ে হতাশার সুর তৈরি করেছিলেন নেতারাই।
সোমেন চন্দের জন্মের আগেই ঘটে গেছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মত ঘটনা। যা দেশকে সাম্প্রদায়িক বৈরিতার দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বা গ্রামের মানুষের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব সেভাবে ছিল না। তখনকার নেতাদের দলীয় বিশেষ করে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের কারণে উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িকতার মত পঙ্কিল বিষয়। এর মূলে আর একটা কারণ সাধরণ মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত না করা। ফলে যে স্বাধীনতা এলো তা কখনোই আপামর জনগণের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো না। শহুরে মানুষের শহুরে আদলে যেন এলো এই স্বাধীনতা। আর এ কারণেই হয়তো আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন বিষয়ক সাহিত্য সবই শহর ভিত্তিক। সোমেন চন্দও এর বাইরে প্রথমটায় বের হতে পারেন নি।
সোমেন চন্দ যে শহর প্রেক্ষাপটে গল্প রচনা করেছেন বেশি সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু তার মানে এই না যে তার গ্রাম সম্বন্ধে ধারণা কম। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে শ্রীযুক্ত নির্মল ঘোষকে লেখা একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘গ্রামের অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর, এমন কি যা কেন্দ্র করে শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে অনেকেই কতগুলো Sweet উপন্যাস রচনা করেছেন, বৈষ্ণবদের সেই আখড়ার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত আমি। কিন্তু ওসব পুরোনো হয়ে গেছে— এখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর দরকার।...
গ্রামের প্রেক্ষাপটে তিনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর গল্পই লিখেছেন। ‘বনস্পতি’ গল্পে তিনি পাঠকের সেই আশা পূরণ করেছেন। ইতিহাসকে পাশে রেখে দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, সামাজিক পরিস্থিতির বিবরণ এবং সেই সাথে সাধারণ কৃষকের জীবনের কথা তিনি বলেছেন এই গল্পে। পলাশীর যুদ্ধের সময় যে বটগাছের অঙ্কুরোদ্গম সেটা দুইশ বছর ধরে ডালা-পালা বিস্তার করে, শিকড়ের জালে আঁটকে ধরে মাটি। তারপর নানা ঘটনার সাক্ষী বটগাছটা প্রবল ঝড়ে উপড়ে পড়ে তখন যখন স্বাধীনতার সুর বেজে উঠেছে। তবে গল্পটা যত বড় ক্যানভাসে নির্মিত তাতে করে এটাকে মনে হয় উপন্যাসে রূপান্তর করা যেত সহজেই। হয়তো সোমেন চন্দের পরিকল্পনাও তাই ছিল, যা আজ আর জানা যাবে না।
সোমেন চন্দ তার গল্পে যে সব চরিত্র এঁকেছেন তার সবই বাস্তব। কোন কাল্পনিক চরিত্র তিনি তৈরি করেন নি। কারণ তার গল্পগুলোই ছিল রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে রচিত। সোমেন চন্দ এই সব চরিত্রের ভিতরে ঢুকে সত্যটাকে তুলে এনেছেন। বলেছেন সাম্যের কথা। বলেছেন রাজনৈতিক আদর্শের কথা। আর এ সবই তিনি করেছেন শিল্পীত ভাষায়। পাঠককে তা চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে ভিতর থেকে ভাবতে শেখায়। সোমেন চন্দের সার্থকতা সেখানেই যে পাঠককে তিনি কোন বিষয় কেবল চিহ্নিত করে দিয়ে শেষ করেন নি। সেই ঘটনা এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ঠ চরিত্রের ভিতরটা খুলে ধরেছেন। পাঠক আজ তাই তাকে পুরো অনুধাবন করতে পারে। আর সেই সাথে সোমেন চন্দ আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে যে সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন তা পাঠকও আজ মানস চোখে দেখতে পাচ্ছেন।