পর্যটক দেখামাত্রই খাবারের জন্য বন থেকে ছুটে আসে ওরা
বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এ বনে বাঘ ও হরিণের পরই রয়েছে বানরের আধিক্য। বনের মধ্যে যে দিকেই চোখ যায় শুধু সৌন্দর্যের হাতছানি। সেই সঙ্গে রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে বানরের বাঁদরামি ও চেঁচামেচি। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করে রেখেছে এ বানরের দল।
চলতি শীত মৌসুমে সুন্দরবনের পর্যটনকেন্দ্রগুলো এখনও মুখর পর্যটকদের পদচারণায়। সুন্দরবনের করমজল পর্যটনকেন্দ্র তার মধ্যে অন্যতম। করমজলে পর্যটকদের দেখামাত্রই খাবারের জন্য ছুটে আসে দলবেঁধে বানর। এ সময় পর্যটকেরা বানরদের চিপস, সফট ড্রিংকসসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার খাইয়ে থাকে। শুক্রবার এ পর্যটনকেন্দ্রে গিয়ে দেখা মেলে এমন চিত্র।
এতে খাদ্যাভ্যাস বদলে যাচ্ছে সুন্দরবনের অনেক বানরের। আগের মতো গাছের ফল-মূল, কচিপাতা বা কাঁকড়া ধরে খাচ্ছে না তারা। এই অভ্যাস বদলের ফলে বানরের উৎপাতে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও বিপজ্জনক আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম।
ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের এত কাছাকাছি থাকার কারণে নানা ধরনের রোগ সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে বানরের। যা গভীর জঙ্গলে মহামারির মতোই ছড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে গোটা সুন্দরবনেরই পরিবেশগত ভারসাম্য যে নষ্ট হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া বানরের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাওয়াতে প্রাকৃতিক স্থিতি কিছুটা নষ্ট হচ্ছে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, ‘সুন্দরবনে বানরের দল যেমন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, জমিতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে হরিণের দল এবং অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণিরা। কারণ বানর গাছে উঠে যত ফল খায় বা পাতা ছিড়ে খায়, তার থেকে বেশি ফল-পাতা নিচে ফেলে, গাছের তলায় হরিণেরা সেইসব কুড়িয়ে খায়। কিন্তু আরও একটা কারণ আছে বানরের সঙ্গে হরিণের ঘুরে বেড়ানোর, সেটা একেবারে প্রাণের তাগিদ। বাঘ শিকার ধরতে এলে গাছের উঁচু ডালে বসা বানর সেটা সবার আগে দেখতে পায় এবং চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। তাতে সাবধান হয়ে যায় হরিণের দলও। জঙ্গলের এই চিরাচরিত নিয়ম ব্যাহত হচ্ছে ফাস্ট ফুডের লোভে বাঁদরের দল জঙ্গলছাড়া হওয়ায়।’
অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন আরও বলেন, ‘পর্যটকদের আসা যাওয়া তো বন্ধ করা যাবে না। তবে তাদের উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়ানোকে নিয়মে বাঁধতে হবে। ঢাকনাযুক্ত পাত্রে উচ্ছিষ্ট খাবার রেখে তা আবার সময় মতো পরিষ্কার করতে হবে। এ নিয়ম না মানলে তাদের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে সংশ্লিষ্টদের। নতুবা বানর সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে।’
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শুকর, উদবিড়াল বা ভোঁদড়ের সবশেষে শুমারি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বনে বানর আছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার।
সুন্দরবনে আসা পর্যটক রবিউল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান বলেন, করমজল পর্যটনকেন্দ্রে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের রুটি ও চিপস কয়েকটি বানর দল বেঁধে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। হয়তো তাদের ক্ষুধা পেয়েছে তাই নিয়ে গেছে।
তবে এই বানরের উৎপাত সম্পর্কে তাদের খাদ্য সংকট বলতে নারাজ পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির।
আজাদ কবির বলেন, ‘বন্যপ্রাণি সবসময় লবণ জাতীয় খাবার পছন্দ করে। এখানে যখন পর্যটকেরা আসেন তারা ওই সব প্রাণিদের খাবার তুলে দেন। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে কোনো লোক দেখলেই মনে করে তার কাছে খাবার আছে। এসব কারণে কোনো কোনো পর্যটকদের আক্রমণ করে বসে এসব বানর। ওদের চরিত্র নষ্ট হয়ে, এখন রাক্ষুসে ভাব হয়ে গেছে।’