পুলিশকে বোকা বানিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা সেজে তল্লাশি-লুটপাট করত নাহিদ

সুনামগঞ্জের নারায়ণতলা গ্রামে একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয় গত ২৫ জানুয়ারি। তল্লাশির নামে এসব বাড়িতে নারীদের শ্লীলতাহানি, স্বর্ণালঙ্কার লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। পরে জানা যায়, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার পরিচয় ছিল ভুয়া। প্রতারণার কৌশল হিসেবে এ পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
র্যাব জানায়, এই ঘটনার ঠিক চারদিন আগে আব্দুল কুদ্দুস ডলার ওরফে নাহিদ এবং বিজন রায় এই দুজন ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যান। বিজনের বাড়ি সুনামগঞ্জ এবং তার সঙ্গে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আগে থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আর ডলার নাহিদ নিজেকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সুনামগঞ্জে মাদকের একটি বিশেষ অভিযান চালাবেন বলে জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাকে জানান। এ সময় নাহিদ অভিযানে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে কাজ করবেন বলেও ওই কর্মকর্তাকে অবহিত করেন।
এ অনুযায়ী নাহিদ তার দলের সদস্যদের নিয়ে নারায়ণতলা গ্রামের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর খোঁজখবর নেন এবং ২৫ জানুয়ারি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করে অভিযানে যান। অভিযানে বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট এবং তল্লাশির নামে গৃহবধূর শ্লীলতাহানি করা হয়; যা অভিযান চলাকালে জানাজানি হলে নাহিদ সেখান থেকে সটকে পড়েন।
ঘটনার পর সুনামগঞ্জ থানায় মামলা হলে র্যাব ঘটনার ছায়াতদন্ত শুরু করে। প্রথমে বিজনকে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাতে নাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। নাহিদ নিজেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কখনও মেজর কিংবা র্যাবে কর্মরত বলে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়ের আড়ালেই বিভিন্ন সময় মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের নামে বাসাবাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার, মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করত। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরা ছবি পাওয়া গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এ তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, দীর্ঘদিন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরির সুবাদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে জানত আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ। নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি থেকে তল্লাশির সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করত। তার অন্যতম কৌশল ছিল, সে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের ঊচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলত এবং কথিত অভিযানে প্রতারণার মাধ্যমে প্রশাসনের সহায়তা নিত।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে লুট: সুনামগঞ্জ সদরের নারায়ণতলা গ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকসেদ আলীর বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে তল্লাশি, শ্লীলতাহানি, লুটের চেষ্টাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া পরিচয়ে অভিযানের নামে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী আত্মসাৎ করে আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ। সে সময় অভিযানের নামে বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং তল্লাশির নামে গৃহবধূর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ডলার নাহিদ বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে মানুষের কাছে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিত। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ২০০৯ সালে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও নিজেকে ১৯৯৬ সালের এসএসসি ব্যাচ দাবি করত। বিভিন্ন কৌশলে এই ব্যাচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতারণা করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সখ্যতার বিষয়ে র্যাব বলছে, গত চার-পাঁচ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপের মাধ্যমে ডলার নাহিদের সঙ্গে বিজনের পরিচয় হয়। রাজধানীতে বিজনের সঙ্গে দেখা করার পাশাপাশি বিজনের বাড়ি সুনামগঞ্জে হওয়ায় সে সুনামগঞ্জ যায়। বিজন সুনামগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। পরে বিজনের সঙ্গে সুনামগঞ্জে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে কৌশলে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদান করে ডলার নাহিদ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান, যে এখানে সে মাদকের একটি চালানের বিরুদ্ধে অভিযান করতে এসেছেন এবং অভিযানের জন্য তাদের সহায়তা চায়। সেসময় সে বিজন ও অন্যান্য সহযোগীদের সমন্বয়ে সুনামগঞ্জের সদর থানাধীন নারায়ণতলা এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে লুটের জন্য পরিকল্পনা করে। প্রথমত তারা লুটের উদ্দেশ্যে এ এলাকায় বিত্তশালী কয়েকটি বাড়ি টার্গেট করে এবং তিন দিন ধরে টার্গেট বাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ও বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে তারা ঘটনাস্থলে যাই এবং স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা জানিয়ে তাদের ঘটনাস্থলে আসতে বলে। এ সময় তারা তল্লাশি করে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয়। বাড়িতে থাকা নারীদের শ্লীলতাহানি করে। এ ঘটনা জানাজানি হলে তারা অভিযান শেষ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তাদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবাদ দেয়। সেসময় নাহিদ নিজেকে গোয়েন্দা শাখার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ডলার নাহিদ গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ঢাকা ও পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গোয়েন্দা সংস্থার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি হতে নগদ অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে। এর আগেও নাহিদ গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে র্যাবের কাছে গ্রেপ্তার হয়েছিল।