ভৈরবে পাদুকা শিল্পমেলা, দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া
দেশে বাণিজ্যমেলা, বস্ত্রমেলা, ইলেক্ট্রনিক পণ্যমেলা, ফার্নিচারমেলা, হালের তথ্যপ্রযুক্তিমেলা এমন কি আবাসনমেলাও হয়ে থাকে হরহামেশাই। কিন্তু এককভাবে পাদুকা বা জুতা শিল্পমেলা প্রথমবারের মতো হয়ে গেল কিশোরগঞ্জের ভৈরবে।
গত ৫, ৬ ও ৭ মার্চ (তিন দিনব্যাপী) উপজেলা পরিষদ চত্বরে জমজমাট এই পাদুকা শিল্পমেলার আয়োজন করে ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতি।
যার সার্বিক সহযোগিতায় ছিল সুইজারল্যান্ডের সুইসকন্ট্রাক্ট ও বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত সংস্থা প্রবৃদ্ধি।
মেলায় রাজধানী ঢাকাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলের ৩৮টি জেলার ৯৯টি উপজেলার ১২০টি মার্কেটের কয়েকশ পাইকারি ব্যবসায়ী অংশ নেন। স্থানীয় ৩০টি বড় কারখানা তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় ডিজাইন ও রঙের পাদুকার পসরা সাজিয়ে বসে।
রমজানের ঈদে পাদুকা শিল্পের সবচেয়ে বড় চাহিদার সময়। এই সময়কে সামনে রেখে মেলাটি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফলে সবচেয়ে ছোট কারখানাগুলোও এক থেকে দেড় লাখ জোড়া জুতার অর্ডার পেয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মেলা উপলক্ষে ভৈরবে আসা বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার জুতার মান খুবই ভালো। দামেও বেশ সস্তা। ঢাকার চেয়ে তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় তাঁরা লাভবান হবেন। তাই তাঁরা এখন থেকে এখানকার জুতাকেই প্রাধান্য দেবেন।
রংপুর সদরের ওমর ফারুক জানান, তিনি আগে ঢাকা থেকে জুতা নিয়ে ব্যবসা করতেন। ভৈরব এসে দেখলেন ঢাকার চেয়ে দামে শস্তা, মানে ভালো ও বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা পাওয়া যায়। তাই তিনি এখন থেকে এখানকার জুতা নিয়েই ব্যবসা করবেন।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা এলাকার ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন জানান, তিনিও আগে ঢাকা থেকে জুতা নিয়ে ব্যবসা করতেন। কিন্তু ভৈরব এসে দেখেন মান ও দামের অনেক পার্থক্য। তাই তিনি এখন ভৈরব থেকে জুতা নিয়ে ব্যবসা করবেন।
অন্যদিকে মেলায় স্থানীয়সহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার খুচরা ক্রেতারাদের ব্যাপক আগমন ঘটে। তারা এক স্টল থেকে আরেক স্টল ঘুরে তাদের পছন্দের জুতা কিনেন। তারা জানান, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হলেও এসব কারখানার জুতা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি বিক্রি হওয়ায় এত দিন বঞ্চিত ছিলেন তাঁরা। মেলার সুযোগে পছন্দের জুতা কমদামে কিনতে পেরে বেশ খুশি তাঁরা। তাঁদের দাবি, প্রতিবছর যেন এমন মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
কারখানার মালিক সহিদ মিয়া ও সবুজ মিয়া জানান, ঢাকার পরই দেশের পাদুকা শিল্পের প্রসার ঘটেছে ভৈরবে। এখানে ছয় থেকে সাত হাজার ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। এখানকার উৎপাদিত পাদুকার মানও বেশ ভালো। ফলে দেশের ৬৪টি জেলাতেই এখানকার পাদুকা বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম তাঁরা পাচ্ছেন না। গার্মেন্টস শিল্পের মতো তাঁরা সরকারি উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী বাজার তৈরির দাবি করেন।
অন্যদিকে ভ্যাট কর্তৃকপক্ষ তাদের অযথা হয়রানি করছেন দাবি করে তাঁরা জানান, যেসব কারখানা ভ্যাটের আওতায় পড়ছেন, তাঁরা তো ভ্যাট দিচ্ছেনই। কিন্তু তারা ক্ষুদ্র কারখানাগুলোকেও হয়রানি করছে। ফলে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন কারখানা বন্ধ করে দিতে। এ ছাড়া সরকার ছোট-বড় সব কারখানাকে প্রণোদনার আওতায় আনলেও, স্থানীয়ভাবে ব্যাংকাররা ছোট কারখানাগুলোকে প্রণোদনা দিতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে তাঁরা সরকারি এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি তাঁদের।
এদিকে ভৈরবে গড়ে উঠা এসব কারখানা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফলে উৎপাদন ও বিপণনে সমন্বয়ের বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। সব কারখানা সরকারি উদ্যোগে মহাসড়কের পাশে একত্রে নিয়ে আসা গেলে এই শিল্পের জন্য ভালো হতো বলে অভিমত তাঁদের।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই মেলার সাফল্য নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আল আমিন মিয়া। তিনি জানান, মেলায় যারা স্টল দিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই পাইকারি ও খুচরা প্রচুর বিক্রি করেছেন। তিনি সরকারিভাবে প্রতিবছর এমন মেলা আয়োজনের দাবি জানিয়ে বলেন, এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা এলে বিক্রি বৃদ্ধি পাবে। আর এতে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক-শ্রমিক সবার জন্যই মঙ্গল হবে।
সুইসকন্ট্রাক্টের কো-অর্ডিনেটর মো. আসাফ উদ দৌলা আশিক জানান, একটি মার্কেটিং এজেন্সির মাধ্যমে দেশের ৩৮টি জেলার ৯৯টি উপজেলার ১২০টি মার্কেটে ক্যাম্পিং করা হয়। ফলে দেশের দূরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও ক্রেতারা মেলায় আসেন। ফলে প্রচুর অর্ডার পায় কারখানাগুলো। আগামীতেও জাতীয়ভাবে সাড়া ফেলার মতো প্রচারণা চালিয়ে এমন মেলার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, ভৈরব এক সময় তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানকার গামছার কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের তাঁতশিল্পের বিপর্যয়ের ঢেউ ভৈরবেও লাগে। পর্যায়ক্রমে এখানকার তাঁতশিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কর্মহারা তাঁতশিল্পের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তুলেন পাদুকা কারখানা। যেগুলো বর্তমানে সম্প্রসারিত হয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে ছয় থেকে সাত হাজার কারখানায় রূপ নিয়েছে। যার মধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ রপ্তানিমুখী ৩৫টির মতো বড় পরিসরের কারখানাও আছে। আর এসব কারখানায় এক লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। নারী শ্রমিক কাজ করেন ১৫ থেকে ২০ হাজার। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। ছয়টির মতো বৃহত্তর পাইকারি মার্কেট এবং ৫০টিরও বেশি পাদুকাশিল্প পল্লী নিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় কর্ম ও অর্থনৈতিক বলয়। যার উন্নতির সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিও জড়িত বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।