রাজশাহীতে মধুমাসের শুরুতেই এসেছে আম

আমকে বলা হয় ফলের রাজা। প্রাকৃতিকভাবে কখনও ঝড়, কখনও শিলাবৃষ্টি আবার কখনও তাপদাহের মতো বৈরি আবহাওয়ায় টিকে থেকে এই আম গাছে গাছে পুষ্ট হয়। এবার মধুমাসের শুরুর দিনই রাজশাহীর বাজারে এসেছে রসালো এই মিষ্টি ফল। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়েই শনিবার থেকে গুটি জাতের আম দিয়ে রাজশাহী অঞ্চলে আমের বাজারজাত শুরু হয়েছে।
তবে ঈদের ছুটির আমেজ কাটিয়ে আমের বাজার জমে উঠতে এখনো দুই সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছেন ফল ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, কম বৃষ্টিপাত ও খরা পরিস্থিতির কারণে অল্প কিছু আম আগেই পেকে গেছে। ফলে মধু মাসের শুরুর দিন থেকেই অল্প পরিমাণ আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে আমের ক্রেতারা এখনো রাজশাহী আসা শুরু করেননি। আম পরিবহণের জন্য শ্রমিকেরাও কাজ শুরু করেননি। এসব কারণে এক থেকে দুই সপ্তাহের আগে পুরোদমে আমের বাজার জমে ওঠার সম্ভাবনা কম।
আমচাষিরা জানান, দীর্ঘদিন বৃষ্টিহীনতার কারণে এবার আমের আকার ছোট হয়েছে। এ বছর ঝড়-বৃষ্টি কম হওয়ায় রাজশাহীতে গাছে গাছে আম কম নষ্ট হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে যে হারে গাছে গাছে মুকুল এসেছিল, চৈত্র-বৈশাখজুড়ে টানা তাপপ্রবাহ ও বৈরি আবহাওয়ার কারণে আমের বাড়ন্ত গুটি ঝরে পড়ায় সে হারে কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার আমের ফলন কম হয়েছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা গ্রামের আমচাষি রুহুল আমিন বলেন, চলতি মৌসুমে খরার প্রকোপ বেশি থাকায় গুটি আমে রং ধরে গেছে বেশ কয়েকদিন আগেই। প্রশাসনের সময়সীমার কারণে তারা এতদিন আম নামাতে পারছিলেন না। শনিবার থেকে আম পাড়া শুরু করেছেন। গুটি আম পাইকারি ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে বেচতে পারলেই তারা খুশি। কিছুটা টক ও আকারে ছোট গুটি আমে আঁশ বেশি। এ কারণে দেশব্যাপী গুটি আমের বাজার নেই। স্থানীয়ভাবে এসব আম বিক্রি হবে বলে আশাবাদী চারঘাটের হলিদাগাছির আমচাষি মোকবুল হোসেন সেখ। তবে কিছু গুটি আম চালানও হবে বলে জানান তিনি।
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের বাজার বসে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে। এখানকার ফল ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘লিচুর বাজারই তো সবে শুরু হলো, এখনই আম কিসের? সাধারণত লিচু শেষ হওয়ার কিছু আগে বাজারে আম উঠতে শুরু করে। সেই লিচু কেবল বাজারে আসতে শুরু করেছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের বাজার বসে রাজশাহীর বানেশ্বরে। সেখানে আজ রোববার ছিল প্রায় আম শূন্য। অল্প কয়েকজন ফল ব্যবসায়ী লিচুর পসরা সাজিয়ে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের দুই ধারে বসেছিলেন।
রোববার বিকেলে বাজারের এক পাশে দেখা গেছে, কিছু যুবক ঝড়ে পড়া কাঁচা আম নিয়ে এসেছেন বিক্রি করতে। ঝড়ে পড়া আম বিক্রি হচ্ছে তিনশ টাকা মণ দরে।
ব্যবসায়ীরা জানান, আমের ব্যবসা জমে উঠলে যেখানে প্রতিদিন শত শত আমচাষি রিকশা বা ভ্যানে টনকে টন আমবোঝাই করে নিয়ে আসেন বানেশ্বর বাজারে, সেখানে রোববার কয়েকজন আমচাষি অল্প পরিমাণ আম বাজারে এনেছিলেন সকালের দিকে। তাঁরা বলেন, আজকে সংগ্রহ করা আমগুলো বিভিন্ন আড়তে প্যাকেট করে রাখা হয়েছে। গাড়ি চলাচল শুরু হলে সেগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হবে।

এদিকে গত কয়েক বছর ধরেই নিরাপদ ও পরিপক্ক আম নিশ্চিত করতে প্রশাসন বিভিন্ন জাতের আম পাড়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আসছে। গত ৭ মে রাজশাহী জেলা প্রশাসন এক সভা করে জেলায় আম পাড়ার সময়সীমা নির্ধারণ করে। প্রশাসনের দেওয়া সময়ানুযায়ী গুটি জাতের আম পাড়ার শুরুর দিন ছিল ১৫ মে। নির্ধারিত সময়েই গুটি আম গাছ থেকে নামাতে শুরু করেছেন রাজশাহীর চাষিরা।
শনিবার দিনের শুরুতে জেলাজুড়ে চাষিরা গাছ থেকে গুটি আম পেড়ে বিকেলেই বিভিন্ন বাজারে তোলেন। কিন্তু ঈদের ছুটি ও পরিবহণ বন্ধ থাকার কারণে রোববারও রাজশাহীতে আমের মোকামগুলো ছিল ব্যাপারীশূন্য। ফলে কেনাবেচাও কম। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আম কিনতে রাজশাহীতে আসে বিপুল সংখ্যক ব্যাপারী।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, ‘গুটি আম সবার আগে পাকে। আঁশযুক্ত এই আমের স্বাদ তুলনামূলক কম, তাই খুব জনপ্রিয় হয়নি। জনপ্রিয় গোপালভোগ, লখনা, খিরসাপাত, ল্যাংড়া ও ফজলি জাতগুলো দেরিতে পাকে। তবে খরার কারণে এ বছর আম পাকতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। তাপদাহের কারণে আমের আকারে ও ফলনেও প্রভাব পড়তে পারে।’
জেলা প্রশাসন বিভিন্নজাতের আম নামানোর যে সময়সূচি আগেই ঘোষণা করেছে, সে অনুযায়ী গুটির পর আগামী ২০ মে থেকে বাজারে আসতে শুরু করবে গোপালভোগ আম। ২৫ মে থেকে বাজারে আসবে লক্ষণভোগ এবং ২৮ মে থেকে পাড়া শুরু হবে খিরসাপাত বা হিমসাগর আম। আর সবচেয়ে লোভনীয় ল্যাংড়া জাতের আম বাজারে আসবে ৬ জুন, হাইব্রিড জাতের আম্রপালি ও আমের রাজা ফজলি আসবে ১৫ জুন থেকে। শেষে ১০ জুলাই থেকে পাওয়া যাবে জাত আম আশ্বিনা ও দেশে উদ্ভাবিত বারি-৪ জাতের আম।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, কয়েক বছর আগে নির্ধারিত সময়ের আগে আম নামিয়ে বাজারে দেওয়ার ফলে রাজশাহীর আমের সুনাম নষ্ট হয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রশাসন এ কারণে আম পাড়ার সময় নির্ধারণ করে দেয়। এবারও তাই করা হয়েছে। নিরাপদ ও পরিপক্ক আম নিশ্চিত হওয়ায় রাজশাহীর আমের সুনাম ও চাহিদা বেড়েছে দেশব্যাপী।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘যদি আবহাওয়ার কারণে কারো বাগানে আম আগেই পেকে যায়, তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অনুমতি সাপেক্ষে তা আগেও নামানো যেতে পারে। চাষিরা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা আমরা চাই না। তবে পরিপক্ক হওয়ার আগে আম পেড়ে ফরমালিন বা কেমিকেল দিয়ে আম পাকানোর অভিযোগ কোথাও পাওয়া গেলে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীতে আমের বাগান বেড়েছে গত কয়েক বছরে। এবার আম বাগান আছে ১৭ হাজার ৯৮৩ হেক্টর জমিতে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে দুই লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন আম হবে বলে কৃষি বিভাগ আশা করছে।