‘বড় দুলাভাই’ হয়ে সেই বাসায় যেতেন নাগরী

ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও ব্যবস্থাপক জানতেন কবি ও গীতিকার শাহাবুদ্দিন নাগরী হচ্ছেন ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের দুলাভাই। ওই পরিচয়েই নিয়মিত নুরুল ইসলামের ফ্ল্যাটে যেতেন নাগরী। তবে নুরুল ইসলামের স্বজনরা জানিয়েছেন, নাগরীকে তাঁরা চেনেন না, কখনো দেখেননি আগে!
গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের নিজ ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের লাশ। ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে ঘটনার দিন ফ্ল্যাটে আসেন শাহাবুদ্দিন নাগরী। ফুটেজ ধরে নাগরীকে আটক করে পুলিশ।
ঘটনার পরের দিন নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন নিহত ব্যবসায়ীর বোন শাহানা রহমান। তিনি নুরুল ইসলামের স্ত্রী নুরানী আক্তার সুমীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুমী ও তাঁদের গাড়িচালক সেলিম হোসেনকে আটক করে। পরে আটক ওই তিনজনকেই ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
‘বড় দুলাভাই’ হিসেবে পরিচয়
এলিফেন্ট রোডের ওই ভবনটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কঠোর। গেটেই দাঁড়িয়ে থাকেন নির্দিষ্ট পোশাকে নিরাপত্তাকর্মী। গেটের ভেতরে সাধারণ পোশাকে অন্য আরো একজন। তিনিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখেন। গেটের ভেতরে ছোট একটি আলাদা কক্ষ। তা ভবনের ব্যবস্থাপকের কক্ষ। ওই কক্ষেই সিসিটিভি মনিটর করার ব্যবস্থা করা। ভবনে প্রবেশ করতে ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। ব্যবস্থাপক ফোন করে পরিচয় নিশ্চিত করার পরই কেউ ভবনে প্রবেশ করতে পারে।
সেখানেই কথা হয় ভবনের ব্যবস্থাপক বাবু স্বর্ণকারের সঙ্গে। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, প্রায় এক বছর আগে ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন নুরুল ইসলাম।
নিজেকে রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটের কাপড়ের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। প্রতিমাসে সময়মতোই ভাড়া দেন তিনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওই বাসায় নুরুল ইসলামের স্বজনরা আসা যাওয়া করতেন। বিশেষ করে তাঁর শ্যালক ও শ্যালকের স্ত্রী বেশ কয়েকদিন ওই বাসায় ছিলেন।’
শাহাবুদ্দিন নাগরী সম্পর্কে জানতে চাইলে বাবু স্বর্ণকার বলেন, ‘কয়েক মাস আগে একটি দুর্ঘটনায় আহত হন নুরুল ইসলাম। এরপর ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। একদিন তিনি নিজেই শাহাবুদ্দিন নাগরীকে নিয়ে এখানে আসেন। আমাদেরকে জানান, ইনি (নাগরী) তাঁর বড় দুলাভাই। তিনি এখন থেকে তাঁর (নুরুল ইসলাম) ব্যবসা দেখাশোনা করবেন।’ পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর ভবনে প্রবেশের জন্য নাগরীকে আর কেউ বাধা দিত না বলে জানান বাবু স্বর্ণকার।
বাবু স্বর্ণকার আরো জানান, নুরুল ও নাগরী দুজনই বেশ ভদ্র স্বভাবের ছিলেন। দুপুর ২টার পর নাগরী ওই ফ্ল্যাটে যেতেন এবং সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে আসতেন।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে বাবু বলেন, ‘সিসি টিভিতে দেখা গেছে নাগরী বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বাসায় প্রবেশ করেন আর সন্ধ্যা ৭ টা ১৭ মিনিটে বের হয়ে যান। রাত ১০টার পর নিজ ফ্ল্যাটে নুরুল ইসলামের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর শরীরের বেশির ভাগ অংশ খাটের নিচে আর বাকিটা ছিল বাইরে। চিকিৎসক জানান, তিনি মারা গেছেন। তখন পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
‘নাগরী নামে কাউকে চিনি না আমরা’
‘বড় দুলাভাই’ শাহাবুদ্দিন নাগরীকে চেনেন না বলে দাবি করেছেন নিহত নুরুল ইসলামের বোন হাসনা আক্তার কুমকুম। তিনি জানান, নুরুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর ওই নাম শুনেছেন তাঁরা। নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলার বাদী শাহানা রহমান ঢাকায় থাকেন তবে এখন নিজ বাড়ি বাগেরহাটে। এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তখন কথা হয় নুরুল ইসলামের অন্য বোন হাসনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, শাহানা রহমান এখন অসুস্থ।
হাসনা জানান, বাগেরহাটে নিজ পারিবারিক কবরস্থানে নুরুল ইসলামকে দাফন করা হয়েছে। বাগেরহাট সদরেই তাঁদের বাড়ি। ব্যবসার কারণে নুরুল ইসলাম দীর্ঘ দিন ধরে ঢাকায় বসবাস করেন। গাড়ি ভাড়া দেওয়া, পার্লারের ব্যবসা, গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানসহ বেশ কিছু ব্যবসা ছিল নুরুল ইসলামের।
হাসনা জানান, নুরানী আক্তার সুমীর সঙ্গে প্রায় ছয় বছর আগে নুরুল ইসলামের বিয়ে হয়। উভয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সুমীর গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার ভরসাপুর গ্রামে। বিয়ের পর থেকে তারা সব সময় পরিবার থেকে আলাদা থেকেছে। খুব বেশি দরকার না হলে পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতেন না নুরুল ইসলাম। সর্বশেষ বেশ কয়েক মাস আগে তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন নুরুল ইসলাম। তবে ঢাকায় শাহানার বাসায় যেতেন নুরুল।
হাসনা জানান, ঢাকায় শাহানার বাসায় মাঝেমধ্যে যেতেন নুরুল। বেশ কয়েকদিন ধরে শাহানাকে তিনি বলতেন যে বাসায় থাকলে তাঁর ঘুম হয় বেশি। অতিরিক্ত ঘুমের কথা বেশ কয়েকবারই বোন শাহানাকে জানান নুরুল। গোপনে নুরুলকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হতো বলে সন্দেহ করছেন হাসনা।
‘তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা যাবে না’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানায় পরিদর্শক (তদন্ত) মতলুবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নিহত ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের বোন বাদী হয়ে যে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই শাহাবুদ্দীন নাগরী ও নুরানী আক্তার সুমী এবং গাড়িচালক মো. সেলিম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল, রিমান্ড শেষে আবারও চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাই তদন্তের স্বার্থে এখন বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না।’