‘দাবদাহে’ মরছে ঘেরের চিংড়ি

বাগেরহাটের মোংলাসহ আশপাশের এলাকার ঘেরের বাগদা চিংড়ি মাছ মারা যাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে অনেক ঘেরে এভাবে মাছ মরে গেছে। এতে চিংড়িচাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, প্রচণ্ড দাবদাহ, পর্যাপ্ত পানির অভাব, অতিরিক্ত লবণ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে ঘেরের বাগদা চিংড়ি মরে যাচ্ছে।
মোংলা উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, মোংলাসহ আশপাশের এলাকায় প্রায় আড়াই যুগের বেশি সময় ধরে বছরের প্রায় আট মাস বাগদা চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু বড়পুকুরে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদার পাশাপাশি গলদা চিংড়িরও চাষ করা হচ্ছে। মোংলার ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ১০ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমিতে বাগদা চাষ হয়। তাতে ছোট-বড় মিলিয়ে ঘেরের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৬০৪টি।
মোংলার বৈদ্যমারী গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মেম্বর ও ঘের ব্যবসায়ী মো. করিম জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে ঘেরে পোনা মাছ ছাড়া হয়। এরপর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ঘেরে মাছ মরে ভেসে উঠছে। আর যেসব জীবিত মাছ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর শরীরও দুর্বল।
সুন্দরবন ইউনিয়নের বাঁশতলা গ্রামের চিংড়িঘের ব্যবসায়ী মো. মুরাদ ও চিলা গ্রামের মাহবুবুর রহমান টুটুল জানান, তিনি শতাধিক বিঘা জমি ইজারা নিয়ে এবার বাগদা চাষের জন্য প্রায় ১৭ লাখ টাকা লগ্নি করেছেন। এবারের চলতি মৌসুমের মাঝামাঝি এ ঘের থেকে যে পরিমাণ মাছ পাওয়ার আশা ছিল, তাতে লগ্নি করা টাকার অধিকাংশই উঠে আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ মাছ মরার কারণে তিনি এখন পর্যন্ত এক লাখ টাকার বেশি মাছ পাননি।
চিংড়িচাষি ইসরাফিল শেখ ও আবু হোসেন পনি জানান, মহাজন, ব্যাংক ও ধার-দেনা করে তাঁরা এবার ঘেরে পোনা ছেড়েছেন। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে অনেক মাছ মরে যাচ্ছে। তা ছাড়া যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার দামও গতবারের তুলনায় কম। এই অবস্থায় কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা।
উপজেলার চিলা, আন্ধারিয়া, বুড়বুড়িয়া, জয়খা গ্রামের কয়েকজন চিংড়িঘের ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, সরকার চিংড়িমাছ রপ্তানি করে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। কিন্তু চিংড়ি উৎপাদনকারীদের সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেই। উপজেলা মৎস্য অফিস ও চিংড়িচাষিদের সচেতন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হচ্ছে না।
কয়েকজন চিংড়িচাষি জানান, এ পর্যন্ত কোনো ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি ঘেরে গিয়ে কী কারণে মাছ মারা যাচ্ছে বা তাদের কী করা উচিত সে বিষয়ে কেউ পরামর্শ দেয়নি। তাই একমাত্র জীবিকা চিংড়ি চাষ নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর সেখানে চিংড়ির উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার ৫০০ টন। আর এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০ টন। গতবার আধা নিবিড় পদ্ধতিতে আটটি পুকুরে চিংড়ি চাষ হলেও এবার তা বেড়ে ১৫টি হয়েছে। এরপরও বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে এবার চিংড়ি উৎপাদন গতবারের তুলনায় অনেক কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চিংড়ির আড়তদাররা জানান, এবার মাছ মরে যাওয়ার কারণে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কম। গতবারের তুলনায় মোংলার আড়তগুলোতে মাছের আনাগোনা প্রায় অর্ধেক।
মোংলা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আনসারী বলেন, বিভিন্ন কারণে বাগদা চিংড়ি মারা যায়। তবে এবারে প্রচণ্ড দাবদাহ, পর্যাপ্ত পানি না থাকা ও অতিরিক্ত লবণের কারণে বেশি মাছ মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া মৌসুমের শুরুতে ঘের প্রস্তুত করার সময় চাষিরা ঘেরের মাটির সঠিক পরিচর্যা করেনি। জমির ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য যে পরিমাণ চুন ব্যবহার করার দরকার তাও ঠিকমতো করেনি।
এই কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত ফরমুলেটেড খাদ্য সরবরাহ না করা, পানি পরিবর্তন ও বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা না করার কারণেও মাছ মারা যাচ্ছে। এসব কারণে চিংড়ি মাছের মধ্যে একধরনের ‘পীড়ন’ তৈরি হয়, যার শেষ পরিণতি মৃত্যু। চাষিদের সচেতনতা তৈরিতে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও জানা তিনি।