চলে গেলেন বাংলাদেশের বন্ধু ফাদার রিগ্যান

ধর্ম প্রচারে ১৯৫৩ সালে ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফাদার মারিনো রিগ্যান। তারপর দীর্ঘ ৬২-৬৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ছিলেন তিনি। শিক্ষা বিস্তারে অতুলনীয় অবদান, বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন এই মানুষটি। ফাদার রিগ্যান ইতালির নাগরিক হয়েও মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন।
গতকাল শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ইতালিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ফাদার রিগ্যান। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক নেমে এসেছে মোংলার শেহালাবুনিয়ার ক্যাথলিক গির্জা ও আশপাশের এলাকায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরস্ত্র বাঙালিদের সহায়তা করেছেন ফাদার রিগ্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্যে যারা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, সেই বিদেশি বন্ধুদেরকে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে। এই নিঃস্বার্থ বিদেশি বন্ধুটিও সেই সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন।
মোংলার শেহালাবুনিয়া গ্রামে ক্যাথলিক গির্জার পাশে ছোট্ট একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন তিনি। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুর, বর্তমানের গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলায় বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক গির্জার প্রধান যাজক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি জসিমউদদীনের সঙ্গে ফাদার মারিনো রিগ্যান। ছবি : সংগৃহীত
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম বলেন, ‘ফাদার রিগ্যানের সহায়তায় আমি নতুন জীবন পেয়েছি। তিনদিন আমি ফাদারের সেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলাম। ওই সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফাদার যেভাবে আমার চিকিৎসা করিয়েছেন, তাঁর ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।’
হেমায়েত উদ্দিন আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন ফাদার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় দিয়েছেন। আবার যখন প্রয়োজন, তখন তিনি যোদ্ধাদের ঘাঁটিতে গোপনে পৌঁছে দিতেন চাল ডাল টাকা।’
স্থানীয় জনগণের মনোবল বাড়াতে ফাদার রিগ্যান যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে নৌকা ভাসিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে একটি নৌকার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘সংগ্রামী বাংলা’। দেশ স্বাধীন হলে আরো দুটি নৌকার নাম রাখেন ‘স্বাধীন বাংলা’ ও ‘মুক্ত বাংলা’। শুধু যুদ্ধের সময়েই নয়, যুদ্ধের পরেও তিনি অনেক বিধবা নারীর পুনর্বাসনে সহায়তা করেন।
ইতালির ভেনেতো প্রদেশের ভিসেঞ্জা জেলার ভিল্লাভেলার গ্রামে ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ফাদার মারিনো রিগ্যানের জন্ম। আট ভাইবোনের মধ্যে রিগ্যান বাবা-মায়ের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ভিল্লাভেলার গ্রামের বাড়িতে তিনি শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন। মারিনো ইতালিয়ান শব্দ। নামটির অর্থ হলো সমুদ্র। রিগ্যান তাঁর বংশগত পদবি। রিগ্যান নামেই তিনি দেশ-বিদেশে সমধিক পরিচিত। তাঁর বাবা রিকার্ডো রিগ্যান ছিলেন ইতালির একটি নাট্যদলের অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় অভিনেতা। আর মা জোক্কে ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা।