ধর্ষণের শিকার কিশোরীর গর্ভপাত, মীমাংসার চেষ্টা

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নে ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীর গর্ভপাত করা হয়েছে। আজ শুক্রবার ওই ঘটনার পর পর পুলিশ ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
এই ঘটনায় রুহুল আমিন ওঝা ও মনির বেপারী নামের দুজনকে আসামি করে ওই কিশোরী নড়িয়া থানায় মামলা করেছে। এদিকে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে সমাজপতিরা আড়াই লাখ টাকায় কিশোরীর পরিবারকে প্রস্তাব দিয়েছেন।
নড়িয়া থানার পুলিশ ও কিশোরীর পরিবার সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৬ মার্চ কিশোরীকে বাড়িতে রেখে তার বাবা-মা আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যায়। ওই রাতে একই বাড়ির সেকান্দার মীরের জামাতা সদর উপজেলার চর পালং গ্রামের মনির বেপারী (৩৫) ঘরে ঢুকে গলায় ছুরি ঠেকিয়ে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করেন। ঘটনাটি কাউকে জানালে হত্যার হুমকি দেন তিনি। মনির বেপারী সম্পর্কে ওই কিশোরীর চাচাতো বোনের স্বামী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন।
এদিকে কয়েক দিন আগে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যরা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। চিকিৎসক জানায়, মেয়েটি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মেয়েটির পরিবার ঘটনাটি ভোজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সিরাজুল ইসলাম খানকে জানায়। বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার আশ্বাস দেন ইউপি সদস্য। এদিকে দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও কোনো সুরাহা না পেয়ে মেয়েটি অভিযোগ করতে থানায় যায়। এ সময় মেয়েটির সঙ্গে মশুরা গ্রামের রঞ্জন হাওলাদার ও নুরুল গোরাপী নামের দুজন থানায় যান। রঞ্জন হাওলাদার ও নুরুল অভিযোগে মনির বেপারীর সঙ্গে রুহুল আমিন ওঝার নাম জুড়ে দিতে বলেন মেয়েটিকে। এতে তার ভালো হবে বলে পরামর্শ দেন তাঁরা। রঞ্জনের পরামর্শে মেয়েটি ভেদরগঞ্জ উপজেলার রুহুল আমিন ওঝা (২৮) ও মনির বেপারীকে আসামি করে ১২ আগস্ট নড়িয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। ঘটনা জানাজানির পর থেকে মনির বেপারী পলাতক।
গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে গ্রামের কয়েকজন লোক উভয় পক্ষকে নিয়ে সালিস বৈঠকে বসেন। তাঁরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে মেয়ের পরিবারকে আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন মনির বেপারীর স্বজনদের। মনির বেপারীর স্বজনরা সালিসের রায় মেনে নিলেও মেয়েটির পরিবার অনাগত সন্তানের পরিচয় দাবি করে।
এদিকে আজ শুক্রবার বেলা ২টার দিকে মেয়েটির প্রসব যন্ত্রণা ও রক্তপাত শুরু হয়। পরে বিকেল ৪টার দিকে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। খবর পেয়ে নড়িয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ আহম্মেদ সেলিম গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটিকে তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন।
ঘটনার শিকার ওই মেয়েটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘মনির বেপারী আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমি অন্য কাউকে চিনি না। আমাকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমি আমার অনাগত সন্তানের পরিচয় দাবি করেছিলাম। দুপুরে আমার পেটে ব্যথা হয়। এরপর আমার রক্তপাত শুরু হয়। যে আমার সর্বনাশ করেছে আমি তার শাস্তি দাবি করছি।’
ঘটনার শিকার ওই মেয়েটির মা বলেন, ‘মনির আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে। আমরা মনিরের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায় গিয়েছিলাম। এ সময় রঞ্জন হাওলাদার ও নুরুল গোরাপী আমার মেয়েকে পরামর্শ দিয়ে আরেকজনের নাম অভিযোগে যুক্ত করিয়েছে। ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম খান ও মাতবররা আড়াই লাখ টাকা নিয়ে ঘটনাটি মীমাংসা করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা তাতে রাজি হইনি।’
মনির বেপারী পলাতক থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মনির বেপারীর শাশুড়ি হাছিনা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের জামাই অভিযুক্ত হয়েছে। সে অপরাধ করেছে বলে মাতবররা আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে মেয়েটিকে দিতে বলেছে। আমরা তাতেই রাজি হয়েছি।’
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম খান বলেন, ‘মেয়েটির পরিবার খুব গরিব। মনির বেপারী মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে শুনেছি। তারা আমার কাছে এসেছিল। আমি তাদের মামলা করার পরামর্শ দিয়েছি। মনির পলাতক থাকায় তার স্বজনদের নিয়ে বসা হয়েছিল। সালিসে মেয়েটির পরিবারকে আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।’
নড়িয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ আহম্মেদ সেলিম বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে। আদালত অভিযুক্তদের বিচার করবে। এ ঘটনায় সালিসে বিচার করার এখতিয়ার নেই। মেয়েটির রক্তপাত শুরু হয়েছে খবর পেয়ে শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে তাকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার প্রসব হয়ে গেছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। কীভাবে তার গর্ভপাত ঘটেছে তা ডাক্তারি পরীক্ষার পরে বলা যাবে।’