সিফাত হত্যা মামলায় শ্বশুরের জামিন, স্বজনদের ক্ষোভ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ওয়াহিদা সিফাত হত্যা মামলার আসামি তাঁর শ্বশুর মোহাম্মদ হোসেন রমজানের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ বুধবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে মোহাম্মদ হোসেন রাজশাহী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেন। ঘটনার পর থেকে সাত মাস ধরে তিনি পলাতক ছিলেন।
এদিকে মোহাম্মদ হোসেনের জামিনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সিফাতের পরিবার। সিফাতের পরিবারের আশঙ্কা তিনি জামিনে থেকে তদন্তকাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। এই জামিন বাতিলে হাইকোর্টে আবেদন করার কথাও বলছেন তাঁরা।
আদালতের বিচারক মনসুর আলম জামিন শুনানির জন্য মামলাটি কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি করেন। পরে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে আবার শুনানি শুরু হয়। ৩০ মিনিট উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক ১০ হাজার টাকার মুচলেকায় তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। আসামি মোহাম্মদ হোসেন রমজান আইনজীবী হওয়ায় তাঁর জামিনের শুনানিতে অংশ নিতে রাজশাহী আইনজীবী সমিতির বেশির ভাগ সদস্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ফলে আদালত কক্ষে বসার জায়গা না পেয়ে অনেক আইনজীবীই দাঁড়িয়ে থাকেন।
এ সময় আইনজীবী হামিদুল হক আদালতে আসামি মোহাম্মদ হোসেন রমজানের জামিনের আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘এটি একটি আত্মহত্যার মামলা। আসামি রমজান গৃহবধূ সিফাতের শ্বশুর। সিফাতের মৃত্যুর সঙ্গে তার শ্বশুরের কোনো সম্পর্ক নেই।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সভাপতি দিল সেতারা চুনি আসামির জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্তের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে সিফাতকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আত্মহত্যার মামলা নয়, হত্যা মামলা। হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে মোহাম্মদ হোসেন রমজানের বাসায়। ফলে হত্যা মামলার আসামি রমজান জামিন পেতে পারেন না। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক মোহাম্মদ হোসেন রমজানের জামিন মঞ্জুর করেন।
এদিকে মামলার বাদী সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার আসামি রমজানের জামিনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আসামি দীর্ঘ সাত মাস পলাতক ছিলেন। রমজান স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি একজন আইনজীবী হওয়ায় পলাতক থেকে মামলার তদন্তকাজে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যার কারণে পুলিশ তাঁকে আটক করতে পারেনি। এখন তিনি জামিনে থেকে মামলার তদন্তকাজে প্রভাবিত করবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। নিম্ন আদালতের এই জামিন আদেশ বাতিলে তিনি হাইকোর্টে আবেদন করবেন বলে জানান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ওয়াহিদা সিফাত ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন রাজশাহী নগরীর আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন রমজানের ছেলে আসিফ ওরফে পিসলীকে। পিসলী বেকার হওয়ার প্রায়ই তিনি সিফাতকে যৌতুকের জন্য চাপ দিতেন। গত ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় নগরীর মহিষবাথান এলাকার মোহাম্মদ হোসেন রমজানের বাড়িতে আড়াই বছরের এক সন্তানের জননী ওয়াহিদা সিফাতের মৃত্যু হয়। ঘটনার চারদিন পর সিফাতের চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার রাজপাড়া থানায় ২০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। মামলায় সিফাতের স্বামী মোহাম্মদ আসিফ ওরফে পিসলী, শ্বশুর মোহাম্মদ হোসেন রমজান ও শাশুড়ি নাজমুন নাহার নাজলীকে আসামি করা হয়। এ মামলায় স্বামী পিসলি জেলহাজতে রয়েছেন।
প্রথমে রাজপাড়া থানার এসআই শরীফুল ইসলাম মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। রাজপাড়া থানা চাঞ্চল্যকর এই মামলায় কোনো অগ্রগতি করতে না পারায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। সেখানেও মামলার অগ্রগতি না হওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।
এদিকে আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জুন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশ দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়া কবরস্থান থেকে সিফাতের লাশ উত্তোলন করে। পরদিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের গঠিত তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। চলতি মাসের প্রথমদিকে সিআইডির কাছে পাঠানো এ মেডিকেল বোর্ডের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সিফাতের মৃতদেহ পরীক্ষার পর দেখা গেছে লাশের মাথার পেছনে ডান দিক থেকে বাম দিক পর্যন্ত বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধেছিল। এর ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সিফাতের দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত বোর্ডের প্রধান ও রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।