সম্পর্কের হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছিলেন মডেল রাউধা!

রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী, মালদ্বীপের নাগরিক ও মডেল রাউধা আতিফ আত্মহত্যা করেছিলেন বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেমিকের প্রতারণা তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) সাইদুর রহমান গত ১৮ মে রাজশাহী মহানগর হাকিম আদালতে এই মামলার যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন বুধবার (২৯ মে) আদালত তা গ্রহণ করেন। একই মামলায় দেড় বছর আগে পুলিশের করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের চেয়ে নতুন কিছু পায়নি পিবিআই। পুলিশের ওই প্রতিবেদনের মতো পিবিআইও রাউধা হত্যায় কাউকে অভিযুক্ত করেনি।
এসআই সাইদুর রহমান জানান, পুলিশ তদন্তে যা পেয়েছিল, তারাও তদন্ত শেষে একই ফলাফল পেয়েছেন। তদন্তে রাউধাকে হত্যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় রাউধা চরম হতাশায় ভুগছিলেন। আর এ কারণেই তিনি আত্মহত্যার পথে গিয়েছিলেন। প্রেমিকের সঙ্গে কথোপকথন ও ছবি থেকে পিবিআই যেসব প্রমাণ পেয়েছে তাতে তাঁর আত্মহত্যার বিষয়টিই উঠে এসেছে।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর পুলিশ রাউধা হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তারও আগে দুই দফার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল মালদ্বীপের এই মডেল আত্মহত্যা করেছিলেন। সে সময় মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক আসমাউল হক। ওই প্রতিবেদনে রাউধার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করা হয়নি। রাউধাকে হত্যা করা হয়েছিল, এমনটিও বলা হয়নি। তাই বাদীপক্ষের আইনজীবী ওই প্রতিবেদনে নারাজি দিতে চেয়েছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আসমাউল হক সে সময় বলেছিলেন, দুই দফার ময়নাতদন্ত, ভিসেরা ও মুঠোফোন পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, রাউধা আত্মহত্যাই করেন। এরপরই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তদন্ত শেষে এবং প্রতিবেদন দাখিলের আগে এ বিষয়টি রাউধার বাবাকেও অবহিত করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেছিলেন, প্রেমে ব্যর্থ হয়েই রাউধা আত্মহত্যা করেছিলেন। মালদ্বীপের শাহী গণি নামের এক যুবকের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এই যুবক পড়াশোনার জন্য লন্ডনে থাকেন। রাউধার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে জানা গেছে, শাহীর সঙ্গে রাউধার সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল। এ নিয়ে প্রচণ্ড মানসিক কষ্টে ছিলেন রাউধা। আত্মহত্যার আগের রাতেও শাহীর সঙ্গে রাউধার কথা হয়েছিল।
২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাজশাহীর নওদাপাড়ায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাস থেকে রাউধা আতিফের (২২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ওই কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মালদ্বীপের মেয়ে রাউধা চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি মডেলিং করতেন।
রাউধার মৃত্যুর দিনই কলেজ কর্তৃপক্ষ শাহ মখদুম থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে। রাউধার লাশ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাজশাহীতে দাফন করা হয়।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাউধা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এরপর মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা রাজশাহীতে গিয়ে ঘটনা তদন্ত করেন।
এদিকে রাউধার মৃত্যুর ঘটনায় কলেজের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটিও তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, রাউধা আত্মহত্যা করেছেন। তবে রাউধার বাবা মোহাম্মদ আতিফ এসব প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছর ১০ এপ্রিল রাজশাহীর আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন।
এ মামলায় রাউধার সহপাঠী ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মেয়ে সিরাত পারভীন মাহমুদকে (২১) একমাত্র আসামি করা হয়। কিন্তু সিরাতকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল হত্যা মামলাটি শাহমখদুম থানা থেকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। পরে কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয়বারের মতো রাউধার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। সে প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, রাউধা আত্মহত্যা করেছেন।
তবে রাউধার বাবা আতিফ তারপরেও দাবি করে আসছিলেন, তাঁর মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। মামলার পর থেকে তিনি রাজশাহীতেই অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর পিবিআইয়ের ওপর ফের মামলাটির তদন্তের ভার পড়ে।
আদালতে দাখিল করা পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও হোয়াটস অ্যাপে প্রেমিক শাহী গনির সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে কথা বলেছিলেন রাউধা। সর্বশেষ মেসেজে লিখেছিলেন, 'তুমি আমাকে মেরে ফেললে।'
প্রতিবেদনে জানানো হয়, মালদ্বীপের নাগরিক শাহী গনি বর্তমানে লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজে মলিকুলার বায়োলজি অ্যান্ড প্যাথোলজি অব ভাইরাসেস ডিপার্টমেন্টে পড়ালেখা করছেন। মৃত্যুর চার মাস আগেও তাঁরা দুজন ভারতে প্রায় দুই সপ্তাহ একসঙ্গে ছিলেন। রাউধার ফোন, ল্যাপটপে পাওয়া ছবি, হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুকে ১৭ হাজার পৃষ্ঠা কথোপকথন বিশ্লেষণ করে তাদের সম্পর্কের উত্থান-পতনের কথা জেনেছে পিবিআই।
পিবিআই কর্মকর্তা এসআই সাইদুর রহমান বলেন, আত্মহত্যার আগের রাতে শাহীর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ঢুকেছিলেন রাউধা। শাহী যে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে, সেটি তিনি সেদিনই নিশ্চিত হন। সে রাতেই রাউধা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার প্রথম চেষ্টা চালান। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে ওই দফায় তাঁকে বিপদমুক্ত করা হয়। রাউধার বিছানায় ইঁদুর মারা বিষও পেয়েছে পিবিআই। তবে তিনি সেটি ব্যবহার করেননি।
পরদিন ভোরে শাহীকে রাউধা লিখেন, 'আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি, কিন্তু তুমি কখনোই আমাকে ভালোবাসোনি। তুমি খুব ভয়ঙ্কর মানুষ। যে ক্ষতি তুমি করেছ তা পূরণ হবার নয়। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি নিঃস্ব, মৃত বোধ করছি।'
দুপুর আড়াইটায় সর্বশেষ মেসেজে রাউধা লিখেন, 'তুমি আমাকে খুন করেছ।' এর পরই কোনো একসময় আত্মহত্যা করেন তিনি।