তাঁদের কাছে বেঁচে থাকাটাই স্বাধীনতা!

‘কেনরে বিধাতা পাষাণ হেন/চারিদিকে তার বাঁধন কেন?/...ওরে চারিদিকে মোর এ কী কারাগার ঘোর/ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘত কর।’ -এই তো সেদিন পড়ছিলাম কলিম খানের ‘আসমানদারি করতে দেব কাকে’ বইটি। এই বইয়ের ‘ঝর্ণাধারা থেকে সৃষ্টিধারা’ প্রবন্ধটিতে লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করেন। রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো পড়তে গিয়ে হঠাৎ আমার এমন এক অনুভূতির তৈরি হয়, মনে হচ্ছিল আমাকে কেউ যেন এরকম আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। বেঁধে রেখেছে। পরাধীন করে রেখেছে। কিন্তু আমরা তো পরাধীনতার কারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধেই ভেঙে ফেলেছি। তাহলে এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ কী?
চলছে বিজয়ের মাস। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল যেখানেই চোখ রাখি না কেন, শুধু বিজয়ের কথা। স্বাধীনতার কথা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার যুগ পর এসে যখন বিজয় নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, সেখানে আমার এমন অনুভূতি নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাই পড়ে গেলাম। তাই গত রাতে ঠিক করলাম, স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা নিয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে জানা দরকার।
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে। যখন বেরোলাম তখন ৯টা বেজে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেই দেখি, এক বৃদ্ধলোক কাগজ কুড়োচ্ছে।
বৃদ্ধলোকটিকে চাচা বলে ডাক দিতেই তিনি কাছে এলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিনি রাজশাহী নগরীর মির্জাপুরে থাকেন। নাম তাঁর খালেক। এই খালেক চাচা একটা দুর্ঘটনায় পর থেকে চোখে বিশেষ কিছু দেখতে পান না। ওদিকে বয়সও হয়েছে বেশ। তাই তিনি কাগজ কুড়িয়েই নিজেকে চালানোর চেষ্টা করেন। তবে সেই চলাটা কেমন জানতে জিজ্ঞাসা করি, ‘দিনে কয় কেজি কাগজ তিনি কুড়োন?’ উত্তরে বলেন, ‘৮-১০ কেজি।’ প্রতি কেজি কাগজের মূল্য কত জানতে চাইলে বলেন, ‘চার টাকা কেজি।’ দৈনিক তার সর্বোচ্চ আয় ৪০ টাকা। এই টাকা দিয়ে বর্তমান সময়ে তিনি কীভাবে দিনাতিপাত করছেন? এ প্রশ্নে তিনি কিছুই বললেন না।
মনে মনে আমি একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম, তারপরও জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি স্বাধীন?’ উত্তরে খালেক বললেন, ‘এ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব নারে বাপ।’ একটু পরে নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, ‘স্বাধীন তো ধরেন নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার মনমতো চলছি। আল্লাহ খাওয়ালে আমি খাচ্ছি, আল্লাহ না খাওয়ালে না-খাচ্ছি। কারো কাছে চাইতে যাচ্ছি না, কাউরে বলছিও না। এটাই স্বাধীন।’
চলে আসতে আসতে হলের গেটের কাছে এসে দেখা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের উচ্চমান সহকারী আশিকুর রহমান আশিকের সঙ্গে। ওনার কাছেও একই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘স্বাধীনতা হচ্ছে আমার নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারার অধিকার। আর আমি এগুলো স্বাধীনভাবে করতে পারি।’ এই সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে একটু হলেও আশ্বস্ত হতে পারলাম। যে স্বাধীন দেশে কেউ কেউ সেই স্বাধীনতা ভোগ করছে। মানে, সবাই পরাধীন না।’
তারপর হল থেকে বের হয়ে দোকানে গেলাম। একটা রুটি খেয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তায় এক বাদাম-বুট বিক্রেতাকে দেখে দাঁড়ালাম। এই বিক্রেতা আবদুর রাজ্জাকের কাছেও ছুড়ে দিলাম একই প্রশ্ন, ‘আপনার কাছে স্বাধীনতা কী? আপনি কি স্বাধীন?’ উত্তরে বললেন, ‘বুঝি না ত, ভাঙ্গাইয়া দিন লাগব। আমি খালি বঙ্গবন্ধুর কথাই কহামু।’
এই লোকের কাছেও খালেক চাচার মতো খেয়ে-না-খেয়ে বেঁচে থাকাটাই স্বাধীনতা। খেতে পারলে ভালো। আর না খেতে পারলে আল্লাহ চায়নি বলে খাওয়া হয়নি!
এ সময় দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন হোছনে আরা। তিনি মহিলা সমিতি, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ যেখানে কাজের সুযোগ হয় সেখানেই কাজ করেন। আমি তাঁকে বললাম, পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর শাসন-শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছে। এ সময় হোছনে আরা বলতে শুরু করেন, ‘পুঠিয়ায় এক মহিলাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলাই দিল।
আবার শাহানক মাইরা ফালাই দিল। এই রকম নির্যাতন আছেই। নির্যাতন বন্ধ হয়? কেউ নির্যাতন বন্ধ করতে পারবে না। এই যে যৌতুক লিয়া, যৌতুক কি সরকার বন্ধ করতে পেরেছে? যৌতুক আরো বেশি লিছে। আমি এক বিয়া জুড়াইলাম, সেখানে ৬০ হাজার টাকা যৌতুক দিতে চাইল মেয়েপক্ষ। বিয়েতে তাদের আরো খরচ আছে। কিন্তু বরপক্ষ এক লক্ষ টাকা চায়। পরে বিয়া হইল না। আবার অনেক বাবাকে দেখা যায়, ভিক্ষা করে মেয়ের বিয়ের যৌতুক দিচ্ছে। এইটা কী নির্যাতন না? কেউ কি বলছে যে, চল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি?’
হোছনে আরা থামলেন না, বলেই যেতে থাকলেন, ‘আমি আমার কথাই বলি, টুকাই ছেলেরা আছে। কখন যে কী করবে তার ভয় তো আমাদের আছেই। আপনারা দুপুর রাইতে যাইতে পারবেন। আমি তো একলা একলা যাইতে পারব না।’
‘আমার আব্বা মারা গেছে ছোটকালে। আমার চাচা জমি আত্মসাৎ করে খাচ্ছে। বলেন, এইডা একটা নির্যাতন না? আমরা বিচার পাচ্ছি না তো। ধরেন, যেখানে যাচ্ছি সেখানেই টাকা দ্যাও। বলেন, চাচা দলিল রেখে দিচ্ছে না। আমি নকল তুলতেছি আমার দিতে হচ্ছে এক হাজার টাকা। আবার খারিজ করতে যাচ্ছি, লায়েবেরা (নায়েব) কচ্ছে এত টাকা না হলে হবে না। ঘুষ না হলে করে দিচ্ছে না। তাহলে কত ঘুরান-ঘুরাচ্ছে দেখেন।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এমন সময় আমার এক ক্লাসমেটকে দেখতে পেলাম। ওর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। ভাবলাম, ওকেও একই প্রশ্ন করব, তরুণরা কী ভাবছে জানার জন্য। এই সময় তামিম সায়াদ নামে আরেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। পরে তিনজনেই হাঁটছিলাম। একটু এগিয়ে তামিম সায়াদকেই জিজ্ঞাসা করলাম সেই একই প্রশ্ন। তামিম বলে, ‘মুক্তভাবে চিন্তা করা, কথা বলার যে অধিকার সেটাই স্বাধীনতা। মানে, আমাদের সমস্যাগুলো মুক্তভাবে বলতে পারব। আমরা স্বাধীনতার আগে এটা করতে পারতাম না পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীদের জন্য।’
এখন পারো?- এর উত্তরে তামিম বলে, ‘টেকনিক্যালি না। একটা সরকারের ভালো-খারাপ দুটি দিকই আছে। আমি যদি খারাপ দিক নিয়ে কথা বলতে চাই, চাপের কারণে আমি সে কথা বলতে পারব না এটাই স্বাভাবিক।’
তামিম বন্ধুর তার কথায় স্বীকারই করছে, স্বাধীনভাবে কথা বলতে না পারা অস্বাভাবিক কিছু না। এরকম হয়তো বেশির ভাগ তরুণের কাছেই আজ স্বাধীনভাবে কথা বলতে না পারাটাই স্বাভাবিক! তবে আমরা দেখলাম, সরকারি কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, বাঁচার অধিকার রাখে। শুধু পারে না সাধারণ মানুষ। তার মানে, স্বাধীনতা আজও কারো কারো জন্য, সবার জন্য নয়!