জামাই মেলায় বাঘাইড়ের দাম ২২ হাজার টাকা

মূলত এটা জামাই মেলা। কিন্তু সবাই এটাকে বলে মাছের মেলা। বলছিলাম গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল গ্রামের মাছের মেলার কথা। আর এই দিনটিকে ঘিরেই এখানে শুক্রবার দিনব্যাপী চলে আনন্দ-উৎসব। দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন উপজেলাবাসী। এক টিকেটে দুই ছবি! বলাটা খুব বেশি অযৌক্তিক হবে না, এই মেলায় আছে একের ভেতর দুই। এককথায় রথ দেখা আর কলা বেচা। কারণ এটা জামাই মেলা হলেও, এখানে বসে মাছের বিরাট মেলা।
বিনিরাইল এবং এর আশপাশে গ্রামে যাঁরা বিয়ে করেছেন, সেই জামাইরা হচ্ছে ওই মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী। তা ছাড়া এই মেলাকে ঘিরে এলাকার জামাইদের মধ্যে চলে একধরনের নীরব প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতাটি হচ্ছে কোন জামাই সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন।
একটা মাছকে ঘিরে ক্রেতা জামাইদের জটলা লেগে আছে। মাছের নাম বাঘাইড়। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ২২ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় রামচন্দ্রপুর এলাকার জামাই ফারুক মাছটির দাম সর্বোচ্চ ১১ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দরকষাকষি। যত না ক্রেতা, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছেন মাছটি দেখার জন্য।
পৌষ মাসের শেষে মাঘ মাসের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে উপজেলার জামালপুর, বক্তারপুর ও জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের মধ্যে বিনিরাইল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় গিয়ে দেখা যায় এই দৃশ্য।
কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তো এসেছেনই। এর বাইরে থেকেও অনেকে এসেছেন উপজেলার সর্ববৃহৎ এই মাছের মেলায়। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে অনেক মানুষ কেবল এই মেলা উপলক্ষেই কালীগঞ্জে এসেছেন। প্রতি বছর পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। এবারের মেলায় তিন শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন।
মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি ইত্যাদির পসরাও বসেছে। মাছের মেলায় সামুদ্রিক চিতল, বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, কালী বাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশি মাছও।
কালীগঞ্জের বিনিরাইলের মাছের মেলার আয়োজকরা জানান, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর ধরে মেলাটি আয়োজন হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।
মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নুরু ও সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন শেখ জানান, ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। এলাকার জামাইরা বলেন, শ্বশুরবাড়িতে মাছ নিয়ে যাওয়া বলে কথা। তাই এলাকার জামাইদের নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই।
তাই স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকানো হয়।
বিনিরাইলের মাছের মেলা নিয়ে কথা হয় কলাপটুয়া গ্রামের সোহেল আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৫ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মাছের মেলাসংলগ্ন মোক্তারপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের সাখাওয়াৎ হোসেন জানান, ‘মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা যতই হোক, এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’ তিনি আরো জানান, শুরুতে এ মেলা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও, বর্তমানে এটা সব ধর্মের মানুষের কাছে ঐতিহ্যের উৎসবে পরিণত হয়েছে।