শত কটূক্তি সয়ে শুয়েই পরীক্ষা দিচ্ছে রুমকি

‘পরীক্ষার কদিন আগে ফুফু বলেছিল, আমার পড়াশোনার পেছনে খরচ না করে আমাকে দিয়ে ভিক্ষা করালে অনেক ভালো ইনকাম হতো। ফুফুর কথা শুনে আমি যে আত্মহত্যা করিনি, এই সাহস দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। ফুফুর কথা শুনে মা খুব কেঁদেছিলেন। আমি বলেছি, তুমি কাঁদছ কেন? তাদের দেওয়া কটূক্তি আর অভিশাপকে আমি দোয়া হিসেবে নিয়েছি।’
আজ সোমবার এসএসসি পরীক্ষা শেষে রাজিয়া সুলতানা রুমকি নিজের আপনজনদের কটূক্তি আর অবহেলার কথাগুলো যখন বলছিল, তখন পাশের অনেকের চোখ ছলছল করলেও রুমকির চোখের পাতা ভিজেনি। তার চোখে মুখে অসম্ভবকে জয় করার এক প্রত্যয় ফুটে উঠেছিল। কণ্ঠ ছিল দৃঢ়।
‘আমি অনেকদূর যেতে চাই। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পরিবারের সবাইকে দেখাতে চাই, শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙ্গিয়ে আমি স্বপ্নকে জয় করতে পেরেছি।’ বলছিল রুমকি।
রুমকি আজ সোমবার থেকে শুরু হওয়া রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সকাল ৯টায় সে এসেছিল পরীক্ষা কেন্দ্র রাজশাহী ল্যাবরেটরী স্কুলে। কেন্দ্রের অন্য শিক্ষার্থীরা সবাই বেঞ্চে বসে টেবিলে খাতা রেখে পরীক্ষা দিলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে সে সুযোগ দেয়নি। কোমরের নিচের অংশ অকেজো হওয়ায় হলরুমের মেঝেতে শুয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাকে।
রুমকির বাড়ি নগরীর পাঠানপাড়া এলাকায়। বাবা খন্দকার হাফিজুর রহমান। তিনি রহমান জুট মিলের ট্রাক চালক। মা নাজনীন বেগম গৃহিণী। বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান শুভ রাজশাহী সিটি কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হাফিজুর রহমান ট্রাক চালিয়ে যা রোজগার করেন তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে রুমকিদের। শারীরিক প্রতিবন্ধী রুমকির পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে মা-বাবা সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার চাহিদা পূরণ করতে, তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। এরই মধ্যে রুমকি পড়ালেখার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। জেএসসি পরীক্ষায় সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। রুমকির খুব ইচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকে রাজশাহী কলেজে পড়বে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের কোনো বিষয় নিয়ে সে পড়বে।
রুমকির মা নাজনীন বেগম বলেন, ‘ছোট বেলায় মেয়ের চিকিৎসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। ঢাকায় নিয়ে গিয়ে অনেক ভালো ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে, এই অসুখ আর ভালো হবে না। তারপরও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। কিন্তু সামর্থ্যের কাছে হার মেনে আর চিকিৎসা করাতে পারিনি।’
নাজনীন বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েই আমার সব। আমার মেয়েকে কেউ কটূক্তি করলে আমার খুব খারাপ লাগে। এটা ভেবে আরো খারাপ লাগে যে আমার মেয়ে কী মনে করবে। কিন্তু কারো কথাতেই সে কিছু মনে করে না। উল্টো আমার মেয়ে আমাকেই সাহস জোগায়। আমি তাকে পড়াতে চাই। কারণ সে সবার থেকে আলাদা। তাকে তার অধিকার থেকে আমি কী করে বঞ্চিত করি।’
এদিকে রুমকিদের পরিবারের কেউ চায়নি সে পড়ালেখা করুক। তার ভাষায়, ‘আমার সাত চাচা আর তিন ফুফু মিলে ৩০ সদস্যের পরিবারের কেউ চায়নি আমি পড়াশোনা করি। কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। বরং কটূক্তি করেছে, যাতে আমি পড়াশোনা না করতে পারি। আমি আজ এসএসসি পরীক্ষা দিতে এসেছি চাচাদের না জানিয়ে। আমার ফুফুরা কেউ আসেনি একবার দেখা করে দোয়া দিতে। তাদের মতে, আমার পেছনে অযথা টাকা খরচ করে লাভ কি। কত অনার্স, মাস্টার্সের ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে চাকরি পাচ্ছে না। আর আমাকে পড়ালেখা করিয়ে কী লাভ হবে।’
একটু থেমে রুমকি আবার বলে, ‘আমারও ইচ্ছে করে পরিবারের কারো বিয়ে হলে বিয়ে বাড়িতে যাব। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে নিয়ে যায় না। বলে তুই বাড়িতেই থাক। আজ ১৭ বছর হলো আমার বাড়ির ছাদ কেমন দেখতে পাইনি। ১৫ বছর ধরে নানির বাড়ি যাইনি। বাড়িতে কেউ এলে আমার চাচারা আমার পরিচয় দিতে দ্বিধা করে। আমার মা আমাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে গেলে সবাই হাততালি দেয়। মায়ের এই কষ্ট করে কোলে নিয়ে যাওয়া দেখে আমার স্কুলের এক ম্যাডাম আমাকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অথচ আমার চাচাদের সামর্থ্য থাকা সত্বেও কেউ এসে আমাকে একটা হুইল চেয়ার কিনে দেননি। এখন এসব আমার সয়ে গেছে। কোনো কিছুতে এবং কারো কথাতে আর কষ্ট পাই না।’
রুমকি জানায়, সিটি করপোরেশনের বর্তমান কাউন্সিলর তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার ভাষায়, ‘আমি কষ্ট করছি। আমার মা-বাবা কষ্ট করে আমাকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। সবাই দেখুক, আমি থেমে নেই। আমার বাবাকে আমার পড়াশোনার খরচ জোগাতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। আমাদের সমাজের একটি মানুষ যদি আমার জন্য এগিয়ে আসে, আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব।’