আত্মহত্যা নয়, যৌতুকের দাবিতে সিফাতকে হত্যা!

আত্মহত্যা নয়, যৌতুকের দাবিতে হত্যা করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ওয়াহিদা সিফাতকে।
প্রায় এক বছর পর আজ বুধবার সকালে রাজশাহী সিএমএম আদালতে চারজনকে আসামি করে দাখিল করা অভিযোগপত্রে এ দাবি করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আহমদ আলী।
অভিযোগপত্রে নিহত সিফাতের স্বামী মোহাম্মদ আসিফ ওরফে পিসলী, শ্বশুর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন রমজান, শাশুড়ি নাজমুন নাহার নাজলী এবং প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ডা. জুবাইদুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আগামী ১৯ এপ্রিল মামলার নির্ধারিত দিনে দাখিলকৃত চার্জশিটের ওপর শুনানি হবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
ডাক্তারকে আসামি করা প্রসঙ্গে সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আহমদ আলী জানান, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ময়নাতদন্ত রিপোর্ট করতে পাঁচ থেকে সাতদিন সময় লাগে। অথচ সিফাতের মৃত্যুর মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিয়ে ডা. জুবাইদুর রহমান মতামত দিয়েছিলেন সিফাত আত্মহত্যা করেছেন। তার এই মতামতের ফলে মামলার স্বাভাবিক তদন্তকাজে বাধা ও সংশয় তৈরি করেছিল। পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশে ৫৮ দিন পর তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড সিফাতের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করে মতামত দিয়েছে, মাথায় আঘাতজনিত কারণে সিফাতের মৃত্যু হয়েছে। একজন ডাক্তারের মতামতের চেয়ে তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের মতামত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণেও সিফাতের মৃত্যু নিয়ে তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের মতামতই প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সিফাতের মৃতদেহের প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. জুবাইদুর রহমান তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মতামত দিয়ে মামলার আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি ইচ্ছেকৃতভাবে মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাঁকে মামলার চার নম্বর আসামি করে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়েছে।’
আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে এক কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ২৯ মার্চ রাজশাহী নগরীর মহিষবাথান এলাকায় শ্বশুরবাড়ির দ্বিতীয় তলায় রহস্যজনক মৃত্যু হয় ওয়াহিদা সিফাতের। ঘটনার পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন সিফাতের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে। তদন্তকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং আসামি ও অন্যান্য সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদে আত্মহত্যার প্রমাণ মেলেনি। চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঘটনার রাতে ওয়াহিদা সিফাতের ঢাকায় বাবার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। ওইদিন বিকেল বাসার দ্বিতীয় তলায় একমাত্র শিশু সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর পর সিফাত ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আসিফ ওরফে পিসলী ইচ্ছেকৃতভাবে যৌতুকের দাবি নিয়ে সিফাতের সঙ্গে ঝগড়া বাধায়। সিফাত এর প্রতিবাদ করলে পিসলী তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং মাথায় আঘাত করে। এতে সিফাত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং একপর্যায়ে মারা যায়। তাঁর মৃত্যুর পর বাবা-মায়ের সহযোগিতায় পিসলী দোতলার প্রধান দরজা বন্ধ করে বিকল্প পথে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এরপর পরিবারের সবাই মিলে প্রচার করে সিফাত দরোজার পর্দা টানানোর এলুমিনিয়াম পাইপে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, সিফাতের শরীরের যে ওজন তাতে পর্দা টানানোর এলুমিনিয়াম পাইপে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলতে গেলে পাইপটি ভেঙে যেত। কিন্তু পাইপটি যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় জব্দ করা হয়েছে।
প্রায় এক বছর পর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত গৃহবধূ সিফাতের বাবা আমিনুল ইসলাম খন্দকার। অভিযোগপত্রের কপি হাতে পাওয়ার পর এ ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য দেবেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরীর মহিষবাথান এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে রহস্যজনক মৃত্যু হয় এক সন্তানেন জননী ওয়াহিদা সিফাতের। এরপর ২ এপ্রিল সিফাতের চাচা খন্দকার মিজানুর রহমান বাদী হয়ে যৌতুকের দাবিতে সিফাতকে হত্যা করার অভিযোগে নগরীর রাজপাড়া থানায় মামলা করেন। গত এক বছরে চার দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পর সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আজ চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেন।