যে অভিযোগে কামারুজ্জামানের ফাঁসি

১৯৭১ সালের ঘাতক আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংগঠক মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গঠন করা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে দুটিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। পরে আপিল বিভাগের রায়ে চারটি অভিযোগ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘অভিযোগ ৩ : সোহাগপুরে গণহত্যার’ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
‘সোহাগপুর গণহত্যার’ অভিযোগটি ছিল, ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারী ধর্ষণ করে। এটি কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে করা হয়। সেদিন ওই গ্রামে ১৬০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একাত্তরে ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর মহকুমার (বর্তমানে শেরপুর জেলা) নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের গণহত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন কামারুজ্জামান। সর্বমোট পাঁচটি অভিযোগে খালাস চেয়ে আপিল করেছিলেন তিনি।
২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের এ আপিল আংশিক মঞ্জুর করেন। সোহাগপুর গণহত্যার দায়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। তবে গোলাম মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের জন্য কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
চলতি বছর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছায়। সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদন করা হয়। কিন্তু তা খারিজ করে দেন আদালত। এরপরই মূলত কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ডাদেশটি অনিবার্য হয়ে ওঠে।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা অন্যান্য অভিযোগ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায় :
অভিযোগ-১, বদিউজ্জামান হত্যা
একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে সারা রাত নির্যাতন করে পরদিন হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়। এই ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু আপিলের রায়ে এই অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ-২, অধ্যক্ষ আবদুল হান্নানকে নির্যাতন
কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে নগ্ন অবস্থায় শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ১০ বছরের সাজা দেন। আপিলেও এ আদেশ বহাল রাখা হয়েছিল।
অভিযোগ-৪, গোলাম মোস্তফাকে হত্যা
একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে কামারুজ্জামান ও আলবদররা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে এই অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ-৫ লিয়াকত, মুজিবুরসহ আটজনকে হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের সময় রমজান মাসের মাঝামাঝি কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দুজনসহ ১৩ জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত, মুজিবুরসহ আটজনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে একসারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়নি।
অভিযোগ-৬, টুনু হত্যা
একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি।
অভিযোগ-৭, দারাসহ ছয়জনকে হত্যা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৭ রমজান কামারুজ্জামান আলবদর সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তাঁর বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন সকালে আলবদররা ওই দুজনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে একসারিতে দাঁড় করান। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফ দেন। আলবদররা গুলি করলে তাঁর পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন।
৪৪ বছর আগের আলবদরের সংগঠক কামারুজ্জামান বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ্য সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি জামায়াতের দ্বিতীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চূড়ান্ত মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেলেন।
এর আগে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ওই রায় কার্যকর হয়।