পথের আলোয় স্কুল

তিনবেলায় কখনো একবার অথবা কখনো দুবার খাবার জোটে। তাতেও কিছু যায়-আসে না ইমনের (৮)। ‘তবে খাবার না খেলেও লেখাপড়া শিখমু। আমার এই স্যাররা বলছে, লেখাপড়া করে আমাদের কাজ দেবে। তাই আমার এই স্যারদের কাছে পড়মু। এখন আমরা অনেক কিছু পড়তে ও লেখতে পারি।’ এমনই জানায় ইমন। রাজধানীর ফার্মগেটের ফুটপাতেই তার ঘর।
রাত সাড়ে ৯টা। ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ড দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল কিছু শিশু সড়কে লাগানো বাতিতে লেখাপড়া করছে। কয়েকজন তাঁদের লেখাপড়া দেখে দিচ্ছে। তাঁরা শিক্ষক। বাসস্ট্যান্ডের একটা উঁচু জায়গায় একটা পলিথিন বিছানো। আর এর ওপরেই চলছে পাঠদান। মাঝেমধ্যে হঠাৎই কোনো শিশু রেখে দৌড় দিচ্ছে। শিক্ষকরা দৌড়ে গিয়ে আবার তাদের বসাচ্ছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী বলছে, এ স্যার, এটা কী হবে। আবার কেউ কেউ বলছে, ও স্যার, এটা কী হবে। হেঁটে যেতে কেউ কেউ ছবি তুলছে ওই পথ স্কুলের।
পথশিশু স্কুলের শিক্ষক মো. জাহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু ছাত্র ফিউচার নেশন বাংলাদেশ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করেছি। সংগঠনের উদ্দেশ্য পথশিশুদের কর্মমুখী শিক্ষাদান। লক্ষ্য শিক্ষা শেষে তাদের যেকোনো কর্ম ধরিয়ে দেওয়া। ঢাকায় দুইটা পথ স্কুল রয়েছে। ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডে আর গুলিস্তান নাট্যমঞ্চে। ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডের পথশিশু স্কুলে ২০ জন এবং গুলিস্তান নাট্যমঞ্চ পথশিশু স্কুলে প্রায় ৬০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এ স্কুল রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে। ঢাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কলেজের ছাত্রদের নিয়ে এ সংগঠন।’
শিক্ষক জাহিদুর রহমান আরো বলেন, ‘এই স্কুল পথে হওয়ায় এ সময় বৃষ্টির জন্য মাঝেমধ্যে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। তবে এই পথশিশুদের অনেকেরই অনেক আগ্রহ রয়েছে লেখাপড়ার। তবে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মা আছে তো বাবা নেই, আবার বাবা আছে তো মা নেই। এদের মধ্যে আদব-কায়দা একদম নেই। আমরা চেষ্টা করছি এগুলো সংশোধনের জন্য। এ কাজে সময় লাগবে।’
ছাত্রছাত্রীদের বই, খাতা, কলম এগুলো কারা দেয়—জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন, ‘আমরা নিজেরাই সবাই মিলে টাকা দিয়ে কিনে দিই।’
এই স্কুলেরই ছাত্র সবুজ। বয়স পাঁচ হবে। জানতে চাইলাম ওর বাবা ও মা সম্পর্কে। সবুজ বলল, ‘আমার বাবা টাকা চুরি করে জেলে আছে। আর আমার মা আমাদের রাতের খাবার সংগ্রহের জন্য কোথায় যেন গেছে।’ দুপুরে খেয়েছ কি না জানতে চাইলে সবুজ বলে, ‘না, শুধু সকালে খাইছি। রাতে মা খাবার পেলে খাবো।’
শিক্ষক মহিউদ্দিন মহিন ও তমাল আহম্মেদ বললেন, ‘এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বই, খাতা, কলম থেকে শুরু করে যা যা লাগে, সব আমাদের সংগঠন থেকে সবাই মিলে চাঁদা তুলে কিনে থাকি। আমরা পর্যায়ক্রমে ঢাকার মধ্যে আরো বেশ কিছু পথ স্কুল করব। তবে যদি কোনো দাতা সংস্থা পাই, তাহলে তাদের সহযোগিতা আমরা নিব।’