সুন্দরবনের অর্ধেক এলাকাজুড়ে হচ্ছে অভয়ারণ্য

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের আরো ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের অর্ধেক এলাকা অভয়ারণ্যে পরিণত হবে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, ছয় প্রজাতির ডলফিনসহ বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, বংশবিস্তার ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নতুন করে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সাতটি, চাঁদপাই রেঞ্জের চারটি, পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের চারটি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের তিনটি কম্পার্টমেন্টকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হচ্ছে।
এর আগে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন এই ম্যানগ্রোভ বনের ৫, ৬, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৪৩ ও ৪৪ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকাকে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ অভয়ারণ্য নাম দিয়ে বিশ্বের ৫২২তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট (বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা) ঘোষণা করে।
‘বিলুপ্তপ্রায়’ তালিকায় থাকা ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন রক্ষায় ২০১২ সালে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের তিনটি এলাকার নদ-নদীকে ‘ডলফিন অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা হয়।
একইভাবে সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ১৮টি নদ-নদী ও খালে মাছসহ সব ধরনের জলজপ্রাণী আহরণও নিষিদ্ধ করা হয়।
বন বিভাগের কর্মকর্তা ও পরিবেশবিদরা বলছেন, এবার সুন্দরবনে নতুন করে আরো ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে অভয়ারণ্য করার মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত এই বনের ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ৩৩৪ প্রজাতির চিরসবুজ বৃক্ষরাজি, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড, ৩১৫ প্রজাতির পাখি ও জলভাগে বিলুপ্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন এবং ২১০ প্রজাতির সাদা মাছের সুরক্ষা সহজতর হবে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) জহির উদ্দিন আহমেদ জানান, মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে এরইমধ্যে সুন্দরবন পরিবর্তিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সংকটাপন্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে। সংরক্ষিত এই বনে জাতীয় পশু রয়ের বেঙ্গল টাইগারের বসবাস। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বন অধিদপ্তর সুন্দরবনের ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে অভয়ারণ্য ঘোষণার মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ করেছে।
সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ১, ২, ৩, ৪, ৭, ১১ ও ১২-বি কম্পার্টমেন্ট। চাঁদপাই রেঞ্জের ১০, ১২-এ, ১৩ ও ১৪ নম্বর কম্পার্টমেন্ট। খুলনা রেঞ্জের ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এবং সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪৯, ৫১- বি ও ৫২ নম্বর কম্পার্টমেন্ট অভয়ারণ্যভুক্ত করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে এই ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে অভয়ারণ্য করতে সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তারাও তাঁদের লিখিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। ফলে এই কম্পার্টমেন্টগুলোকে অভয়ারণ্য ঘোষণার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের অর্ধেক এলাকা অভয়ারণ্য হবে বলেও জানান সিএফ জহির উদ্দিন আহমেদ।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুর ইসলাম সরকারের এই সিদ্ধান্তে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের এ পদক্ষেপকে সফল করতে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। বিদ্যমান তিনটি অভয়ারণ্য সুরক্ষায় বনবিভাগের অতীত ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। সাম্প্রতিককালে পূর্ব অভয়ারণ্য এলাকায় ইউনেস্কোর একটি দল জেলেদের মাছ ধরতে দেখতে পায়। যে ঘটনা দেশ-বিদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে বনবিভাগের নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও সন্তোষজনক ছিল না। নতুনভাবে আরো বনাঞ্চলকে অভয়ারণ্য ঘোষণার পাশাপাশি তার সুরক্ষাকে নিশ্চিত করতে হলে বন প্রশাসনকে সংরক্ষণ ক্ষেত্রে আরো আন্তরিক হতে হবে। নজরদারি ও লোকবল বৃদ্ধিসহ সৎ, দেশপ্রেমিক, দক্ষ, আধুনিক বনকর্মী নিয়োগ এবং পরিবেশমনষ্ক সরকারি-বেসরকারি তৃতীয় পক্ষকে তদরকির সযোগ দিতে হবে বলে মত দেন তিনি।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাইদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে সুন্দরবনের তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটজে সাইট সংলগ্ন এলাকার ১৮টি কম্পার্টমেন্টকে নতুন করে অভয়ারণ্য ঘোষণার ফলে পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ১২টি কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ৯টি অভয়ারণ্য হয়ে যাবে। অভয়ারণ্যের জল-স্থলের সব ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে একমাত্র ইকো-ট্যুরিস্ট ছাড়া কেউই এসব এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না। এর ফলে সুন্দরবনের এসব অভয়ারণ্যে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ-বংশবিস্তার ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা বনবিভাগের পক্ষে সহজতর হবে।