এক নামে কারখানা, অন্য নামে ভেজাল ওষুধ

খুলনার বহুল আলোচিত শিল্পপতি কাজী শাহনেওয়াজের চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা থেকে গতকাল সোমবার যে বিপুল ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে তা ছিল একমাত্র ছেলে প্রিন্সের নামে। কারখানাটির পুরো নাম ‘প্রিন্স ফার্মাসিউটিক্যালস অ্যান্ড হারবাল লিমিটেড’।
কিন্তু র্যাবের অভিযানের সময় ওই প্রতিষ্ঠানের নামে টেস্টি ওরস্যালাইন ও মুভ ছাড়া কোনো ওষুধ পাওয়া যায়নি। সেখানে মিলেছে এসিআই, অপসোনিন, এসকেএফ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওষুধ, মোড়ক ও লেবেল। এসব ওষুধের মধ্যে এসিআইয়ের বহুল প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল ফ্লুক্লক্স ৫০০ এমজি রয়েছে।
এসব ভেজাল ক্যাপসুল চালের গুঁড়া দিয়ে রাবারের মোড়ক দিয়ে তৈরি করা হতো। এরপর তা ঢাকার মিটফোর্ডের ওষুধের মার্কেটে সরবরাহ করা হতো বলে জানিয়েছেন র্যাব-৬ খুলনার অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম।
ভেজাল ওষুধ কারখানার মালিক কাজী শাহনেওয়াজ খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের গত কমিটির সহসভাপতি ছিলেন বলে জানিয়েছেন জেলা কমিটির বর্তমান দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ। তিনি জানান, কাজী শাহনেওয়াজ বর্তমান কমিটিতে কোনো পদে নেই।
কাজী শাহনেওয়াজ খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির গত কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি।
র্যাব ৬-এর সহকারী পরিচালক এএসপি মো. মিজানুর রহমানের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ১০ অক্টোবর সোমবার র্যাব ৬-এর মেজর মোহাম্মদ সুরুজ মিয়া, এএসপি মো. মিজানুর রহমান, র্যাব-১ ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফিরোজ আহমেদের নেতৃত্বে খুলনা জেলার রূপসা থানাধীন চর রূপসা এলাকায় (ফেরিঘাট সংলগ্ন) যৌথ মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযান পরিচালনাকালে দেশের স্বনামধন্য ওষুধ কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের অপরাধে শাহনেওয়াজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক কাজী মো. শাহনেওয়াজকে (৬৮) বিপুল ভেজাল ওষুধ ও ওষুধ উৎপাদনের যন্ত্রপাতিসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আসামিকে উদ্ধার হওয়া আলামতসহ খুলনার রূপসা থানায় হস্তান্তর করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) ধারা মোতাবেক মামলা করা হয়।
এদিকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সুবিধাভোগী একটি মহল প্রচারণা চালায়, কাজী শাহনেওয়াজ তার চিংড়িমাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানা ভাড়া দিয়েছিলেন জনৈক হাবিবকে। কাজী শাহনেওয়াজ নিজেই ঘটনার পর মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর মাছ কোম্পানি বন্ধ থাকায় ভাড়া দেওয়ার কথা বলেন। তিনি দাবি করে ছিলেন, প্রতিষ্ঠানের নিচতলা এক লাখ টাকা ভাড়ার চুক্তি ছিল। পরে তাদের ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় তলাও ভাড়া দেওয়া হয়।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওষুধ প্রস্তুত করার স্থানে যে কাগজপত্র পাওয়া গেছে সেখানে দেখা যায়, প্রিন্স ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড হারবাল লিমিটেড। নিচে ছোট আকারে লেখা রয়েছে : এ সিস্টার কনসার্ন অব শাহনেওয়াজ গ্রুপ। ঠিকানা : চর রূপসা, খুলনা।
আর একটি বিলের কাগজে রয়েছে প্রিন্স ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কোম্পানি (শাহনেওয়াজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান)। ঠিকানা : প্রিন্স টাওয়ার, দ্বিতীয় তলা, বাড়ি নম্বর : ৫৮৪, রোড নম্বর : ৬, বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড, আদাবর, মোহাম্মদপুর ঢাকা।
কাজী শাহনেওয়াজের একমাত্র ছেলের নাম প্রিন্স। খুলনার রূপসা স্ট্যান্ড রোডে তাঁর বাড়িটির নামও ছেলের নামে ‘প্রিন্স হাউস’।
প্রিন্স ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কোম্পানির বিলে দেখানো হয়েছে- ডিটারজেন্ট পাউডার, শ্যাম্পু, সরিষার তেল, টয়লেট ক্লিনার, ক্রিম, লজেন্স, ওরস্যালাইন, চিরতা ক্যাপসুল, কালোজিরা তেল, স্পিরুলিনা ট্যাবলেট ইত্যাদি উৎপাদন এবং বিক্রি করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সামনে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো সাইনবোর্ড নেই। সাইনবোর্ডে লেখা শাহনেওয়াজ গ্রুপ ও শাহনেওয়াজ সী ফুডস লিমিটেড। এত কিছু তৈরি করার কথা বললেও র্যাবের অভিযানের সময় শুধু প্রিন্স ওরস্যালাইন ও প্রিন্স গুরু মুভ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে মিলেছে নামি প্রতিষ্ঠানের বিপুল ভেজাল ওষুধ, মোড়ক ও লেবেল।
কারখানা ভাড়া দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানে শাহনেওয়াজ গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রিন্স ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড হারবাল লিমিটেডের কার্যক্রম চলত। নিজেদের কিছু পণ্য তৈরির পাশাপাশি নামী প্রতিষ্ঠানের ভেজাল ওষুধ তৈরি করা হতো।
অভিযান শেষে র্যাব-৬ খুলনার অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, র্যাবের অভিযানে ঢাকার মিটফোর্ডে যে ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে, তারাই সন্ধান দিয়েছে খুলনার রূপসার চরে ওষুধ কারখানার কথা। র্যাব বিভিন্ন মাধ্যমে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েই শাহনেওয়াজ গ্রুপের কারখানায় অভিযান চালিয়েছে।