মোংলায় জীবিতদের মৃত দেখিয়ে জমি বিক্রি!

বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের দিগরাজ শিল্প এলাকায় জীবিত ব্যক্তিদের মৃত দেখিয়ে সম্পত্তি হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি দালাল চক্র। অভিযোগ উঠেছে, প্রতারিত হয়ে এর মধ্যে ভিটেমাটি হারিয়েছেন অনেকেই।
জালিয়াত এসব চক্রের সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রার, ভূমি অফিসের কর্মচারী ও ভূমি জরিপকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
দিগরাজের শেলাবুনিয়া ও বিদ্যারবাওন এলাকা পরিদর্শন করে এসব দালাল চক্র সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোংলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের দিগরাজ বাজারসংলগ্ন শেলাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত দ্বারিকনাথ রায় মোড়লের দুই ছেলে রতন রায় মোড়ল ও ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল। রতন রায় মারা গেলে তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী রায় (৭০) স্বামীর ওয়ারিশ সূত্রে এক একর জমির মালিক হন।
এদিকে, দ্বারিকনাথ রায় মোড়লের ভাই হরষিৎ রায় মোড়ল প্রায় ৩০ বছর আগে মারা যান। তখন তাঁর স্ত্রী ফুলকুমারী ওরফে ফুলমালা (৮০) ওয়ারিশ সূত্রে এক একর ২৬ শতাংশ জমির মালিক হন। ফুলমালা এখন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী।
সন্তান না থাকায় বৃদ্ধ এ দুই নারী জমিগুলো ভোগ-দখল করছিলেন। এ অবস্থায় প্রয়াত রতন রায় মোড়লের ভাই ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল তাঁর বিধবা বৌদির জমি প্রতারণার মাধ্যমে নিজ নামে নামজারি করিয়ে নেন এবং চাচিকে মৃত দেখিয়ে জাল কাগজপত্র তৈরি করেন।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল বিধবা দুই নারীর দুই একর ২৬ শতাংশসহ মোট ৩ দশমিক ২৮৩১ শতাংশ জমি চলতি বছরের ১ জুন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এক কোটি এক লাখ ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন।
ফলে ‘মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই’ হারিয়ে সাবিত্রী বর্তমানে তাঁর ভাই ব্রাজোন মণ্ডলের বাড়িতে আছেন। আর ফুলমালা চিকিৎসা ছাড়াই এখন জীবন কাটাচ্ছেন অন্যের বাড়ির বারান্দায়।
উল্লিখিত বিষয়ে ধীরেন্দ্রনাথ রায় মোড়ল জানান, তিনি নিজের সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। অন্য কারো নয়। তিনি আরো বলেন, তিনি অশিক্ষিত লোক। দলিল যাঁরা লিখেছেন, তাঁরাই এসব বিষয় ভালো জানবেন।
তবে বেঁচে থাকা দুই বৃদ্ধার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন বলে দাবি করেন ধীরেন্দ্রনাথ।
জীবিত দুই বিধবাকে মৃত দেখিয়ে দলিল লিখে দিয়েছিলেন বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল। তিনি জানান, কাগজপত্র সঠিক থাকায় তিনি দলিল লিখে দিয়েছেন। এই দলিল সাব-রেজিস্ট্রার অঞ্জু দাসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।
তবে সাব-রেজিস্ট্রার অঞ্জু দাসকে খুঁজতে তাঁর অফিসে গেলে তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন বলে জানান অফিস সহকারীরা।
জমি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি রেজাউল করিম বলেন, ‘কে মারা গেছেন আর কে বেঁচে আছেন, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কাগজপত্র সঠিক থাকায় মালিকদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করা হয়েছে।’
রেজাউল করিম আরো বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করেই সাব-রেজিস্ট্রার দলিলের কাজ সম্পন্ন করেছেন।
সম্পত্তি হারানোর আশঙ্কা
এদিকে একই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অভিনাষ চন্দ্র রায় (৯০) তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। জমি বিক্রির জন্য অব্যাহত হুমকি পাচ্ছেন তিনি।
অভিনাষ জানান, দালাল চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে রাতারাতি জমির কাগজপত্র বদলাতে পারে। দালাল চক্রগুলো চাপ দিয়ে তাদের পছন্দের কোম্পানির কাছে এলাকার জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে মালিকদের। ওই চক্রের কথামতো জমি বিক্রি না করলে জমির রেকর্ড, পরচাসহ অন্য কাগজপত্র রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলে তাঁরা। থাকে না বসতভিটার জমিও।
জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ড
সম্প্রতি নদীপথে শেলবুনিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ের ভাঙনকবলিত রাস্তায় টাঙানো রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির সাইনবোর্ড। এ ধরনের সাইনবোর্ড ফসলি জমি, বসতবাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি, এমনকি নদীর চরেও টাঙানো রয়েছে।
দেখা যায়, পরিত্যক্ত একটি বাড়ির আঙিনায় টাঙানো রয়েছে বায়না সূত্রে মালিকানার সাইনবোর্ড। একই বাড়িতে গাছের সঙ্গে অপর একটি কোম্পানির সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।
এ গ্রামের বাসিন্দা সুরঞ্জন মোড়ল জানান, প্রয়াত গোবিন্দ মহলদারের ছেলে মানস মহলদার সাইনবোর্ড লাগানো ওই জমির প্রকৃত মালিক। কিন্তু নীলকমল গাইন নামের এক দালাল চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে ওই ১০ কাঠা জমির বায়নাচুক্তি করেছেন সহযোগী দালাল সজল দাসের সঙ্গে। আর এ বায়নাচুক্তির কারণে তিনি কোম্পানির সাইনবোর্ড দিয়েছেন জমিতে।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মানস মহলদার জানান, লেখাপড়ার কারণে মা নমিতা মহলদারকে নিয়ে এখন তিনি খুলনা শহরে বসবাস করছেন। ভুয়া কাগজপত্রে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি নীলকমল গাইন নামের দালাল আত্মসাৎ করেছে। তবে চক্রটি এলাকায় ক্ষমতাবান হওয়ায় তাদের কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
জানতে চাইলে জমি কেনাবেচায় জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করে নীলকমল গাইন দাবি করেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া জমি ক্রয়-বিক্রয় সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত যত জমি তিনি কেনাবেচা করেছেন, সেগুলোর বৈধতা আছে।
বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল চন্দ্র রায় জানান, জীবিতদের মৃত দেখিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো ওয়ারিশকাম সনদপত্র দেওয়া হয়নি।
তবে এলাকায় একাধিক দালাল ও প্রতারক চক্রের তৎপরতা নিয়ে নিখিল উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওই এলাকার প্রকৃত জমির মালিকরা এখন নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
জমি জালিয়াতির নেপথ্যে
বাগেরহাটের মোংলা বন্দর এলাকা ঘিরে এখন গড়ে উঠছে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখন অনেক জমির প্রয়োজন। কোম্পানিকে জমি পাইয়ে দিতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জমির দালাল ও প্রতারক চক্র।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, শেলাবুনিয়া গ্রামে নীলকমল গাইন, শ্রীনিবাস বায়, সজল দাস, সুজয় বালা, বিষনু বৈরাগী, দুর্গা বালা, নির্মল রায় দালাল চক্র এখন বেশ প্রভাবশালী।
শেলাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা সনজিৎ রায়, সুজন রায় ও কিশোরী শীল জানান, দালাল চক্রের সদস্যরা এলাকায় বেশ ক্ষমতাবান। সাধারণ মানুষের জমি জালিয়াতির মাধ্যমে বেচাকেনা করে থাকে তারা। এলাকায় বড় বড় কোম্পানি এ চক্রের মাধ্যমেই জমি কেনে। জমির দালালি করেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে দালাল চক্রের সদস্যরা। তাদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়ে ভিটেমাটি হারিয়েছেন গ্রামের অনেকেই।
এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) তালুকদার আবদুল খালেক ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) পঙ্কজ চন্দ্র রায়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে বলেও জানায় ক্ষতিগ্রস্তরা।