নির্বাচনের দাবিতে এক ‘মোহনায়’ রাজনৈতিক দলগুলো
ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। সাত মাসের মাথায় এসেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে পতিত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্রের ‘নীল নকশা’ নিয়ে মাঠের কর্মসূচিতে সোচ্চার হচ্ছে। এর জন্য অন্তবর্তী সরকারকেই দায়ী করছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। পাশাপাশি নিজেদের দায়টাও স্বীকার করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা। দেশের চলমান সংকট নিরসনে গত ছয় মাস ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘রোডম্যাপের’ দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। দাবি আদায়ে আগামী দিনে ‘সক্রিয়’ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো। তবে এসব নিয়ে এখনই সরাসরি কিছু বলতে নারাজ দায়িত্বশীলরা।
রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সরকার অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে অধিকাংশ রাজনৈতিকদল এখন নির্বাচনের দিকে ‘ফোকাস’ করছে। নির্বাচিত সরকার এসব ইস্যু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা। যে কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার তারা। নির্বাচনের দাবিতে তারা ‘এক মোহনায়’।
অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রযোজনীয় সংস্কার শেষেই নির্বাচন দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সংস্কার কতটুকু হলো কি হলো না-এটা বিষয় নয়। দেশের রূপান্তর দরকার, পরির্বতন দরকার। এটা নিয়ে যদি বিলম্ব করা হয়, দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে।’
ড. মঈন খান বলেন, ‘অন্তবর্তী সরকার কি করল এটা কেউ বেশিদিন মনে রাখবে না। এর আগে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করেছে তাদের কয়জনকে মনে রেখেছে দেশের মানুষ? সুতরাং, সরকারকে পরিবর্তনের দিকেই হাঁটতে হবে।’ সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দরকার বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটা ‘সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ’ প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রতিনিয়ত সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মানুষের বিপুল প্রত্যাশার জায়াগটা ছিল জনজীবনে স্বস্তি আসবে। বাজার তো এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। এখনো সারা দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রয়ে গেছে। যেহেতু আমরা সকল রাজনৈতিক দল সরকারকে সমর্থন করছি, মানুষ কষ্টে থাকলেও সহ্য করছে। বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ধৈর্য ধারণ করছে। জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বড় দাগে সরকারের সাফল্যের কথা বলা যাচ্ছে না।’
সাইফুল হক বলেন, গণহত্যার বিচার নিয়ে এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতা আছে। সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের দূরত্ব আছে। সরকারের প্রধান স্টেক হোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি রয়েছে। কিছুটা একলা চলো নীতিতে রয়েছে সরকার।
রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতাশ্যা পূরণে কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে- এমন প্রশ্নে সাইফুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ব্রডলি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। সরকারের এতো ব্যর্থতার পরও সরকারকে সময় দিচ্ছে। সরকারের প্রতি সমর্থনটা অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুটা ত্রুটি–বিচ্যুতি থাকলেও সাধারণ মানুষ এটা মেনে নিয়েছে। কারণ বিগত সরকারের পতনের পার আওয়ামী লীগ ধারণা করেছিল লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। একটা সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে। বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথা বলা হয়েছিল, এর কিছুই হয়নি। গণউত্থানের পর এটাই অনেক বড় অর্জন বলতে পারি।’
সাইফুল হক বলেন, ‘সরকারকে আমরা সমর্থন করছি। এটা কিন্তু শর্তহীন সমর্থন নয়। আমরা অনেক বিষয়ে সমালোচনা করছি সরকার যাতে সঠিক পথে থাকে, পথ না হারিয়ে ফেলে। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনে জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রধান লক্ষ্যে যাতে সরকার অবিচল থাকে।’
সাইফুল হক বলেন, ‘ছাত্রদের দল করার যে প্রবণতা, সরকার যদি পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে, এটা যদি চলতে থাকে, তাহলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। এই সরকার যদি নিরপেক্ষতা ধরে না রাখে, বিপদ আছে। রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু তাদের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এটা কালকে না উঠলে, পরশু, পরশু না উঠলে, তার পরদিন কিন্তু উঠবেই।’ সাইফুল হক বলেন, ‘বিগত ছয় মাস ভারতসহ বেশ কিছু দেশের প্রবল বিরোধিতার মুখে সরকার টিকে থাকল, এটা এক ধরনের সাফল্য বলা চলে। সরকার সংস্কার করে একটি নির্বাচনের ধারণ দিয়েছে এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই।’ নির্বাচন কমিশন গঠন করাকে সরকারের সাফল্য বলেও মত দেন তিনি।
জনগণের আস্থা অর্জন প্রসঙ্গে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা তো সরকারে নেই। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমরা জনগণের দুঃখ-দুর্ভোগের কথা বারবার তুলে ধরছি। গত তিনটা নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। সরকারের প্রথম যে কাজটা করার দরকার ছিল নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করা- এটা তারা করতে পারেনি। চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে তারা উল্লেখ করেছেন তিন ধাপে সংস্কার হতে পারে। ছয় মাসে স্বল্প মেয়াদি, এছাড়া ১২ মাস মেয়াদি এবং ৪৮ মাসের সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচনের দাবিতে কোনো কর্মসূচিতে যাবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচনের দাবিতে আমরা (১২ দলীয় জোট) সোচ্চার আছি। যেহেতু আমরা যুগপৎভাবে বিএনপির সঙ্গে একটা এলায়েন্সে আছি, তাই বিএনপি যে কর্মসূচি দেবে আমরা তাতে শতভাগ একমত।’
এদিকে নির্বাচন নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা না করলেও সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।
নির্বাচন প্রশ্নে সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, যৌক্তিক সংস্কারের পরই নির্বাচন চায় জামায়াতে ইসলামী। তিনি বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুত নির্বাচন চাই। তার আগে যৌক্তিক সংস্কার হওয়া দরকার।’
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র সালেহ উদ্দিন সিফাত এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, নির্বাচন সংস্কার প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। সংস্কারকে নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড় করানোটা ঠিক না। আমরা নির্বাচন চাই, তবে সেটি হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন৷ গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে। এমনটাই আমাদের প্রস্তাব।’
সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণদের মধ্যে যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো ধারণ করতে পারছে না। যার ফলে তরুণদের এই নব আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে এমন একটি রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছি। আইনজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার থেকে শুরু করে রিকশাশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, দলিত-হরিজনের মতো আন্ডার রিপ্রেজেন্টেড কমিউনিটির নাগরিকগণ আমাদের সাথে সংযুক্ত হচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রায় আড়াইশ' থানায় আমাদের প্রতিনিধি কমিটি গঠিত হয়েছে।’