ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটুকু এগোল?
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/08/younus22.jpg)
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বে দেশে রিজার্ভ চুরি, অর্থ লোপাট, ব্যাংকিং খাতে লোপাট, রাজনৈতিক নিপীড়ন, ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল দেশ। ভারতের সঙ্গে সর্ম্পক ছিল অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের মতো। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হলো।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সাড়ে ১৫ বছরের জমে থাকা সব দাবি যেন একসঙ্গে ফুঁসে ওঠে। গত ছয় মাসে প্রায় ১৬০টির মতো দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। তন্মধ্যে ষড়যন্ত্র ছিল বেশ, বিশেষ করে সরকার গঠনের পরদিন থেকে পুলিশ, আনসার, প্রশাসন থেকে শুরু করে অসহযোগিতা শুরু করে। দফায় দফায় দাবি নিয়ে সড়কে ও সরকারে উত্তাপ ছড়িয়েছেন রিকশাচালক থেকে শুরু করে পোশাক শ্রমিকরাও। গত ছয় মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে প্রায় শতাধিক দাবি ও আন্দোলনে সরকার এসব সামলাতে অনেকটা সময় পার করতে হয়েছে। তবে এত সমস্যার মধ্যেও এ সরকারের অর্জন অনেক।
ছয় মাসে যেসব খাতে উন্নতি করেছে সরকার
সভা-সমাবেশের অধিকার
সভা-সমাবেশ করা সব নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু দমন-নিপীড়ন করতে গিয়ে সরকার মানুষের এ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়। ঘরোয়াভাবেও মানুষ এ অধিকার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। তবে গত ছয় মাসে এ অধিকার পরিপূর্ণভাবে ফিরে পেয়েছে।
বাক-স্বাধীনতার অধিকার
ফ্যাসিবাদী সরকার দেশে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গত ১৫ বছর ধরে মানুষের বাক-স্বাধীনতার অধিকারও কেড়ে নেয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশে বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেও তাকে গুম-খুন করা হতো। রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিক কেউ রেহাই পায়নি এ জায়গায়। তবে ছয় মাসের ১৬০টি আন্দোলন বলে দেয় মানুষ পুরোপুরি বাক-স্বাধীনতা উপভোগ করছে।
ফিরেছে রাজনৈতিক অধিকার
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমন্বায়ে বিরোধী দল দমন শুরু করে সরকার। বিএনপি-জামায়াতের ওপর নেমে আসে জুলুম–নির্যাতন। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গুম-খুন-হত্যা, আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় একে একে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের। মামলা-হামলায় ঘর-বাড়ি ছাড়া হন লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মী। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের ছয় মাসে ফ্যাসিবাদ ঘনিষ্ঠদের ছাড়া সব রাজনৈকি দলকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
রিজার্ভে হাত না দিয়ে ঋণ পরিশোধ
বর্তমান সরকার গঠনের পর বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ কমতে শুরু করেছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিদেশি ঋণ ব্যাপকভাবে পরিশোধ শুরু করা হয়েছে। মাত্র ছয় মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত না দিয়েও কয়েক বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে স্বল্পমেয়াদী দুই বিলিয়ন ও দীর্ঘমেয়াদী তিন বিলিয়ন ডলার রয়েছে। ফলে শুধু বেসরকারি খাতেই বিদেশি ঋণ কমে এসেছে।
দুর্নীতি করার সংস্কৃতি রোধ
গত ১৫ বছরে রাজনীতিবিদ, বাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ এমন কোনো খাত ছিল না যেখানে টপ টু বটম দুর্নীতি হয়নি। বরং ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করার সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে, এটি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল দেশে। সরকারি-বেসকারি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। দেশটির প্রতিটি সেক্টরে চলেছে দুর্নীতির মহোৎসব। গণ-আন্দোলন ও অনেক মানুষের রক্তের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্বে এসেছে। এ অবস্থায় দুর্নীতির বিষয়ে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ বা শূন্য সহনশীলতা বজায় রয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত
২০০৯ সাল শেখ হাসিনা সরকার বাক-স্বাধীনতার মতো হরণ করা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। একে একে বন্ধ করা হয় দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ বহু গণমাধ্যম। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন স্বাধীনতা উপভোগ করছে।
বিদেশে অর্থ পাচার রোধ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। বর্তমান সরকার এ পাচাররোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক কঠোর হস্তে দমন করার চেষ্টা করছে। সাবেক মন্ত্রী এমপি ও আমলাদের প্রতি নিয়ত গ্রেপ্তার ও ব্যাংক হিসাব তলব করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাচ্ছে সরকার।
বিদেশি বিনোয়োগে উৎসাহ
গত ১৫ বছরে দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কদর্য পন্থায় ঋণ প্রদান এবং খেলাপির আড়ালে ব্যাংক ব্যবস্থাসহ আর্থিক খাতের চরম অব্যবস্থাপনা অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিতে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় নিপতিত হয়। বিগত সরকারের আমলে নানামুখী উন্নয়নের গালগল্পের মাঝে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। মিথ্যার বেসাতি মূলত বাজার ব্যবস্থার আরও ক্ষতি করেছে। সচেতন জনগণ সম্যক উপলব্ধি করতে পারলেও দমন-পীড়নের ভয়ে তা প্রকাশ করতে অপারগ ছিল। বিভিন্ন গবেষণা-লেখনীতে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ব্যবসায়ী-আমলাদের কারসাজির অনেক তথ্য উঠে এসেছে। মানুষের ক্ষোভ-যন্ত্রণা যে গণরোষের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সে সম্পর্কে অনেকে সতর্ক করেছেন; কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার লোভ শাসকগোষ্ঠীকে এসব আমলে নিতে ন্যূনতম তাগিদ দেয়নি। ফলস্বরূপ, ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ফ্যাসিস্ট তকমা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিদেশিদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন
শেখ হাসিনার সরকার দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল। গত ১৫ বছরে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তিনটি পাতানোর নির্বাচন করে দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছিল। বিনা ভোটের নির্বাচন, রাতের আঁধারে ভোটগ্রহণ, সর্বশেষ নিজ দলীয়দের দিয়ে ডামি নির্বাচন ছিল শেখ হাসিনার প্রতারণার উৎস। এতে দুর্নীতিবাজ নির্বাচন কমিশনাররা এসব ভুয়া ভোটের আয়োজন করে। কমিশন বাদ দিয়ে গত ২৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন ও চারজন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) শপথ নিয়েছেন।
চার কমিশনার হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তাহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
প্রবাসী আয় বৃদ্ধি
গত ছয় মাসে (আগস্ট থেকে জানুয়ারি) প্রবাসী আয় এসেছে এক হাজার ৪০৪ কোটি ৮০ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের (২০২৩-২০২৪) একই সময় (আগস্ট থেকে জানুয়ারি) প্রবাসী আয় এসেছিল এক হাজার ৯৩ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এই সময়ের মধ্যে প্রবাসী আয় বেড়েছে ৩১০ কোটি ৮৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার বা ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগের বছরের জানুয়ার তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেড়েছে তিন দশমিক ৪১ শতাংশ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিপিএম৬ হিসেবে দেশে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২০ কোটি ১৬ লাখ ডলারে অবস্থান করেছে। মোট রিজার্ভ দুই হাজার ৫৫৪ কোটি ডলার।
সংস্কার কমিশন গঠন
রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রথম দফায় ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এগুলো হলো—সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এসব কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদন পেশ করে বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করেছে।
এ ছাড়া সরকার আরও কয়েকটি কমিশন গঠন করে। এগুলো হলো—গুম কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকার বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাত সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন। এ ছাড়া গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি গঠন করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একাধিক টাস্কফোর্সও। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিও গঠন করেছে সরকার।
পুলিশ বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি
অন্তর্বর্তী সরকারকে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়তে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। গত ছয় মাসে পুলিশের মন্থর তৎপরতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও উত্তরায় প্রথম দিকে ঘন ঘন ডাকাতির খবর পাওয়া যায়। পরে পরির্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হলে সাম্প্রতিক সময়ে এসব ডাকাতি-ছিনতাই অনেকাংশে কমে এসেছে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী সময়ে দেশের নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মাঝে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানান দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। প্রতিদিনই সরকারকে কোনো না কোনো মহলের আন্দোলন মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ সময়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা প্রাঙ্গণে অবস্থান ও ঘেরাও কর্সূচিও হয়েছে। এসব আন্দোলন নিয়ে সক্রিয় রয়েছে সরকার। আন্দোলনকারী দাবি দ্রুত বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতে আস্থা
শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচার করে দিয়েছে। অপরদিকে ব্যাংকগুলো হয়ে গেছে ‘খোঁড়া’। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘১০টি ব্যাংক লাইফ সাপোর্টে আছে’ বা দেউলিয়া হয়ে গেছে। এ সময়ে কোনো এলসি পর্যন্ত খোলা যেত না। গ্রাহকরা ব্যাংকে গিয়ে টাকা উঠাতে পারত না। তবে পঙ্গু হওয়া এসব ব্যাংক ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সচল হয়েছে লেনদেন।
আটক সাবেক এমপি-মন্ত্রী
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সাবেক সরকারের এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী সদস্যদের গ্রেপ্তার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সাবেক সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আমলাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন মামলায় ইতোমধ্যেই সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, কাজী জাফরউল্লাহ, ড. আব্দুর রাজ্জাক, ফারুক খান, শাহাজান খান, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, আহমদ হোসেন, সাধন চন্দ্র মজুমদার, আব্দুস সোবহান গোলাপ, আ স ম ফিরোজ, জুনাইদ আহমেদ পলক, হাজী মো. সেলিম, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, আসাদুজ্জামান নূর, নুরুল ইসলাম সুজন, ফরহাদ হোসেন, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, টিপু মুনশি, দীপু মনিসহ বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি-মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের অনেকে একাধিক দফায় রিমান্ডের মুখোমুখিও হয়েছেন। জাতীয় পার্টির কয়েকজন সাবেক এমপি-মন্ত্রীও আটক হযেছেন। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক সচিব জাহাংগীর আলম, হেলালুদ্দীন আহমেদ, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বিচারপরিত শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আদালতে নেওয়ার সময় তাদের অনেকের ওপর হামলাও হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের লাল পাসপোর্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তার সবগুলো বাতিল করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে গত ২৩ অক্টোবর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িতসহ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ক্ষমতাবলে, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
প্রশাসনে নিয়োগ-পদায়ন-পদোন্নতি
প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে। হাতে গোনা দুয়েকজন ছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব সচিবসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন পদায়ন হয়েছে। বিগত সরকারের কয়েকজনকে পদচ্যুত, চুক্তি বাতিলসহ বেশিরভাগ প্রভাবশালী আমলাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারদের পরিবর্তন করা হয়েছে।
বিগত ১৬ বছর বঞ্চিত কর্মকর্তাদের এ সময়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ দুই-তিন দফায় পদোন্নতি পেয়েছেন। তাদের পদায়নও করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। বর্তমান সরকারের প্রতি অনুগত এমন অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এ সময়ে জেলা প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের আন্দোলনসহ তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। ডিসি নিয়োগে প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ ওঠে। যদিও সরকারের তদন্তে ওই অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগসহ সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী দলগুলোকে বাদে অন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক দফায় বৈঠক করেছেন। সরকার প্রথম দিকে একটি বৈঠকে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানালেও পরবর্তীকালে ছাত্র-জনতার বিরোধিতার মুখে দলটিকে দ্বিতীয় দফার সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সংলাপ ধারাবাহিক এবং এই সংলাপ অব্যাহত থাকবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
ক্ষমতা নেওয়ার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শতাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের প্রায় সবার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
বিচার বিভাগ পুনর্গঠন
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিচার বিভাগেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। গত ১০ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের অন্য পাঁচজন বিচারপতিও তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন। এ ঘটনার পর নতুন বিচারপতি নিযুক্ত হন আপিল বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একই সময়ে আপিল বিভাগে নতুন আরও চার বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়। অপরদিকে সরকার নতুন করে হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে।
সাজানো মামলা থেকে অব্যাহতি
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সেইসঙ্গে, পাল্টে যাচ্ছে অনেক মামলার রায়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দেওয়া ছয় মাসের দণ্ড ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অপরদিকে, শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মামলাগুলো ‘মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ছিল বলে অভিযোগ করে আসছিল বিএনপি।
এর বাইরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলাকালে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন গত দেড় দশকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি বিএনপি, জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতাকর্মী, যাদের মধ্যে ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া গিয়াস উদ্দিন আল মামুনও রয়েছেন। তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সাজা ইতোমধ্যে মওকুফ হয়েছে।
স্থাপনার নাম পরিবর্তন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বেশকিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম ইতোমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। সাভারের ‘শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের’ নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাম পরিবর্তনের কার্যক্রম শুরু করে অন্তর্বতীকালীন সরকার। ওই প্রতিষ্ঠানের নাম করা হয় জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’–এর নাম পরিবর্তন করে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের নাম পরির্তন করে গাজীপুর সাফারি পার্ক নামকরণসহ শেখ মুজিব, শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
এর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে উপদেষ্টা পরিষদের চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় আট দিবস বাতিল
অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে পরিচিত আটটি জাতীয় দিবস বাদ দিয়েছে। দিবসগুলো হলো—ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ও ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
এর আগে শোক দিবসের সরকারি ছুটিও বাতিল করে সরকার। এদিকে এ দিবসগুলো বাতিলের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দলীয় দিবসগুলো জাতীয় দিবস হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো জাতীয় দিবস হওয়ার মতো নয়।’
ইউপি বাদে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়া হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মাথায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। যেসব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন, সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
ভারতকে স্পষ্ট বার্তা
গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে নতজানু সম্পর্ক রেখেছিল। সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যাসহ দেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়াসহ ভারতের ইচ্ছেমতো বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল হাসিনা সরকার। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। তবে এ ধারা বদলে গেছে গেল ছয় মাসে। বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার প্রতিবাদ এবং ভারতের সঙ্গে হওয়া সব অসম চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছে সরকার।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে ভারতকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। এর মধ্যে তিনটি জেলার পাঁচটি সীমান্তে বিএসএফকে বেড়া নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
একইসঙ্গে সীমান্ত নিয়ে করা সমঝোতা স্মারকগুলো লঙ্ঘন করে ভারত যেসব কাজ করতে চেয়েছিল, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আগামী ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনে বেশকিছু বিষয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরমধ্যে সীমান্ত হত্যা, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানবপাচার, নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টন এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়ানো বন্ধ করা।
দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বেগ পোহাতে হচ্ছে। চাল, তেল, ডিম, পেঁয়াজসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপণের দামবৃদ্ধিতে হিমশিম কেটে হচ্ছে জনসাধারণকে। এ ছাড়া চুরি-ছিনতাই বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে চাপ সামলাতে হচ্ছে।