সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অজানা, ১৮ দফা সুপারিশ তদন্ত কমিটির

সম্প্রতি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে লাগা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ করা না হলেও, এর সম্ভাব্য সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি, সুন্দরবনে ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ১৮ দফা সুপারিশও করেছে কমিটি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের দাখিল করা পৃথক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুন্দরবনের শাপলার বিল ও টেপার বিলে আগুনে মোট ৬ দশমিক ৬৩ একর বনভূমি পুড়ে গেছে। এই দুই স্থানের অগ্নিকাণ্ডে সুন্দরবনের গাছপালা, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের আনুমানিক ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭০ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ রবিবার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে বন অধিদপ্তরের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের পাঁচ সদস্যের কমিটি এখনও এই ঘটনার তদন্ত করছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান এবং সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাস জানান, সুন্দরবনের শাপলার বিল এবং টেপার বিলে আগুনের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং তাকে এই দুটি কমিটির প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে কমিটি গত ৭ এপ্রিল সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দপ্তরে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আগুনে সুন্দরবনের শালপার বিলে ৪ দশমিক ৪৩ একর বনভূমি পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শাপলার বিলে ৩ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যের ১০ কুইন্টাল সুন্দরী গাছ, তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার কুইন্টাল বলা গাছ, ১ হাজার ৫০ টাকা মূল্যের পাঁচ কুইন্টাল গেওয়া গাছ এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশের আনুমানিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ৩ লাখ টাকা।
এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে টেপার বিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২ দশমিক ২০ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই এলাকায় আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ১ হাজার কুইন্টাল বলা গাছ, ৪২০ টাকা মূল্যের দুই কুইন্টাল গেওয়া গাছ এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশের আনুমানিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা।
এসিএফ দ্বীপন চন্দ্র দাস আরও জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও কমিটি সম্ভাব্য সাতটি কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছে। সুন্দরবনে প্রায় প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের পক্ষ থেকে ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিমত দিয়েছে যে, তাদের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করা গেলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে সুন্দরবনে আগুন লাগানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম জানান, সুন্দরবনের শাপলার বিল এবং টেপার বিলে আগুনের ঘটনায় গঠিত দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তদন্ত কমিটি সুন্দরবনে আগুন লাগার সম্ভাব্য যে সাতটি কারণ উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে—
১. অবৈধভাবে মৌয়াল বা জেলে, বাওয়ালী সুন্দরবনে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহের জন্য ধোঁয়া তৈরির লোফা বা বিড়ি-সিগারেটের মোথার গোড়া থেকে অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।
২. অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হিসেবে ঘটনাস্থলে একটি মৌচাকের মধু সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত লোফার কিছু অংশ এবং সংগ্রহকৃত অবশিষ্ট অংশ দেখা গেছে। ওই খান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়ার সম্ভবনা বেশি হতে পারে।
৩. অবৈধভাবে সংরক্ষিত সুন্দরবনে গবাদি পশুচারণকারীদের ব্যবহৃত বিড়ি-সিগারেটের মোথার গোড়া থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে।
৪. কলমতেজী টহল ফাঁড়ির টেপার বিল এলাকায় বর্ষাকালে প্রচুর জিওল মাছ (শিং, মাগুর, কই) পাওয়া যায়। জিওল মাছ আহরণের পূর্ব প্রস্ততি হিসেবে বিলের জায়গা পরিষ্কার ও ছাই দিয়ে ভর্তি করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে দুষ্কৃতিকারীরা আগুন লাগাতে পারে।
৫. বন বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য দুষ্কৃতিকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে সংরক্ষিত সুন্দরবনে আগুন লাগাতে পারে।
৬. চাঁদপাই রেঞ্জের বৈদ্যমারী টহল ফাঁড়ি থেকে শরণখোলা রেঞ্জের দাসেরভারানী টহল ফাঁড়ি এলাকার সীমানাপ্রাচীর সংলগ্ন খড়মা ও ভোলা নদী দুটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ওই নদী দুটি ভরাট হওয়ার কারণে নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী ছোট-বড় খাল দিয়ে বনের মধ্যে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে উক্ত বনাঞ্চলের ভূমি জোয়ার-ভাটার সময় নিমজ্জিত হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে নদী ও সংযোগ স্থাপনকারী ছোট-বড় খালগুলো সচল না থাকায় অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।
৭. ভোলা নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় মানুষ ও গবাদি পশু অতিসহজে সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস না পেলে এবং ছোট-বড় সংযোগ খালগুলো সচল থাকলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করত। ভোলা নদী হতে সুন্দরবনের মাটিতে জোয়ারের পানি প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। এতে শুকনো পাতা বনভূমিতে পড়ে থেকে উঁচু পাতার লেয়ার বা হিউমাস সৃষ্টি করেছে। চৈত্র মাসের তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় শুকনো ডাল ও পাতায় ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন স্থির তড়িত আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে সুপারিশ
তদন্ত কমিটি যে ১৮টি সুপারিশ করেছে এরমধ্যে রয়েছে, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সুন্দরবনের ২৪, ২৫ এবং ২৭ নম্বর কম্পারমেন্টে মধু আহরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করা। অবৈধভাবে প্রবেশ করলে মৌয়ালদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। ভোলা নদী এবং নদীর সঙ্গে সংযোগকারী সকল নদী-খাল পুনঃখনন করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা। ভোলা নদীর পাড়ে অবস্থিত উঁচু বাঁধ কেটে নদীর পানি সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা। ভোলা নদী সংলগ্ন সংযোগ খালগুলো—বিশেষ করে কলমতেজি, কাটা ভারানী, ছোটভারানী খালসহ অন্যান্য ছোট খাল পুনঃখনন করে সুন্দরবনে পানি প্রবেশ নিশ্চিত করা। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধক করতে বনের সীমানা এলাকায় ব্যাপক সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা। লোকালয় সংলগ্ন সংরক্ষিত সুন্দরবনের ২৪, ২৫ এবং ২৭ নম্বর কম্পারমেন্টে মার্চ মাসের পূর্বে বলা ও নলখাগড়া সম্পূর্ণ রূপে অপসারণের জন্য পাস দেওয়া যেতে পারে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বনজীবী, দুষ্কৃতকারী এবং সকল প্রকার গবাদি পশু সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ করা। সুন্দরবনের স্টেশন এবং ক্যাম্পে শ্যালো মেশিন এবং পর্যাপ্ত পাইপের মাধ্যমে ছোট ছোট অগ্নিনির্বাপণ ইউনিট তৈরি করা। আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং বনের মধ্যে জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করে নজরদারিসহ দ্রুত অগ্নিকাণ্ড শনাক্ত করার মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এছাড়া যেসব স্থানে স্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে না— সেসব স্থানে প্রস্তের ফায়ার লাইন তৈরি করতে হবে। অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে বনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত ড্রোনের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থা করা। দু’টি অগ্নি নির্বাপণ ইউনিট স্থাপন করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ টহল ফাঁড়িগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করতে হবে।
এছাড়া নদী ও খাল দ্রুত পুনঃখননের ব্যবস্থা নিতে হবে। মধুর পাশ দেওয়ার আগে ধোঁয়া দেওয়ার যন্ত্র (ধোঁয়াদানী বা স্মোকার) অথবা ধোঁয়া দেওয়ার মেশিনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত বন বিভাগের সহায়ক প্রতিষ্ঠান সিপিজি ও ভিটিআরটি সদস্যদের মাসিক ভাতা দেওয়াসহ তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানের বিবেচনা করা প্রয়োজন। সুন্দরবনে আগুন নেভানোর কাজে সহায়তাকারী বন বিভাগের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় বহন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২৩ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার সুন্দরবনের শাপলার বিল এলাকায় গহিন বনে আগুন দেখতে পায় বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এরপর শুরু হয় আগুন নেভানোর কাজ। ৪ দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে সুন্দরবনের আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো হয়।
এর আগে ২২ মার্চ সকাল ৭টার দিকে বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের কলমতেজি ক্যাম্পের টেপার বিলে আগুন দেখতে পায় বন বিভাগ। একদিন পর ২৩ মার্চ দুপুরে টেপার বিলের আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো হয়।