জলাতঙ্ক পর্ব-২
কুকুর-বিড়াল নিধন নয়, সাময়িক বন্ধ্যত্ব চান স্বেচ্ছাসেবীরা

ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সম্প্রতি কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন বিষাক্ত প্রাণীর আক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জলাতঙ্ক রোগের ঝুঁকি এড়াতে প্রতিষেধক টিকা (ভ্যাকসিন) নিতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন নাগরিকরা। আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই কুকুরের কামড়ে ক্ষতিগ্রস্ত, এরপর রয়েছে বিড়ালের আক্রমণের শিকার লোকজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্রাণী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই প্রাণিগুলোর নিধন নয়, বরং মানবিক পদ্ধতিতে সাময়িক বন্ধ্যত্ব কার্যক্রমের আওতায় আনার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রাণিকল্যাণ সংগঠনগুলো। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও এমন একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা জানানো হয়েছে।
বিপন্ন পাখি ও প্রাণী রক্ষায় চার দশক ধরে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কুষ্টিয়ার শাহাবউদ্দিন মিলন। স্থানীয়ভাবে ‘ফক্সম্যান’ নামে পরিচিত এই প্রাণিপ্রেমী শুধু তাদের রক্ষাই করেন না, বোঝার চেষ্টা করেন তাদের ভাষা ও আচরণ।
এ বিষয়ে এনটিভি অনলাইনকে শাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, ‘আমি পশুপাখি ও প্রাণিদের নিয়ে কাজ করি। এদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি, আর অনেকটা বুঝতেও পারি। কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণী সৃষ্টিকর্তা মানুষের উপকারের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এদের কোনোভাবেই নিধন করা উচিত নয়। আমরা চাই, এ প্রাণিগুলো যেন তাদের প্রাকৃতিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, এই প্রাণিগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকলে অনেক সময় জনসাধারণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় খাবারের সংকট দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা কখনো কখনো মানুষের জন্য বিরক্তির কারণ হয়। কিন্তু এর সমাধান নিধনের মাধ্যমে নয়,’ বলেন মিলন।
শাহাবউদ্দিন মিলনের পরামর্শ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এসব প্রাণির খাবার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ‘আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, তাদের জন্য একটি সহনশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে মানুষ ও প্রাণী উভয়েই শান্তিতে বসবাস করতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।
প্রাণী নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যত্বকরণের বিষয়েও মত দিয়েছেন শাহাবউদ্দিন মিলন। তিনি বলেন, ‘স্থায়ী বন্ধ্যত্বকরণ নয়, সাময়িক বন্ধ্যত্বকরণই হতে পারে উপযুক্ত উপায়। আর এই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে।’
বিপন্ন কুকুর ও বিড়ালদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘রকস টিমে’র প্রধান মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রক এনটিভি অনলাইনকে জানান, কুকুর ও বিড়ালের মতো প্রাণিদের নিধন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে আইন রয়েছে, এবং রকস টিম শুরু থেকেই এ ধরনের নিধনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিধনের বিপক্ষে। বরং বন্ধ্যত্বকরণের মাধ্যমে সংখ্যাটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কারণ একটি কুকুর সাধারণত ১২ বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং একসাথে ৮ থেকে ১০টি বাচ্চা দিতে পারে। ফলে খুব দ্রুতই এদের সংখ্যা বেড়ে যায়।’
আব্দুল কাইয়ুম রক বলেন, ‘ধরুন, কোনো এলাকায় দুই-তিনটি কুকুর থাকলে তারা সহজেই টিকে থাকতে পারে—খাবারের সংকট হয় না, মানুষও বিরক্ত হয় না। কিন্তু যদি সংখ্যাটা বেড়ে যায়, তখন খাবারের সমস্যা দেখা দেয় এবং মানুষের জন্যও এটি উৎপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য সকল কুকুর ও বিড়ালকে শতভাগ টিকার আওতায় আনতে হবে, যাতে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি কমে। এবং সাময়িক বন্ধ্যত্বকরণ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যাতে এসব প্রাণির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর এই দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।’
উল্লেখ্য মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রক বিপদের মুখে থাকা কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপের কুকুরগুলোর জন্য তার নেতৃত্বে চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে অবস্থান করেন। এসব কুকুরগুলোকে খাবার ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয় তার দল।
আব্দুল কাইয়ুম রক বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে যখন খাবারের সংকটে কুকুরগুলো হুমকির মুখে পড়ে, তখন আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। আমাদের টিম চিকিৎসকসহ খাদ্য ও ওষুধ নিয়ে সেখানে গিয়ে কাজ করেছে। এটা কেবল দায়িত্ববোধ থেকে নয়, ভালোবাসা থেকেই করা।’
এ বিষয়ে ‘অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম’-এর কর্ণধার সুমি বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি প্রশ্ন শুনেই কলটি কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার কল করলেও, তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সরকারি উদ্যোগ : প্যাট অ্যানিমেল নিয়েও কাজ করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
প্রাণী অধিকার রক্ষায় সরকারি পর্যায় থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. শেখ শাহিনুর ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরাও এক সময় শুধু দুধ বা মাংস উৎপাদনকারী প্রাণী নিয়ে কাজ করতাম। কিন্তু বর্তমানে প্যাট অ্যানিমেল, অর্থাৎ কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণী নিয়েও কাজ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী সময়ে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
ড. শেখ শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু আইন রয়েছে—এই প্রাণিগুলোকে নিধন করা যাবে না, করলে শাস্তির বিধান আছে—তাই এদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, যেটি এ বছরের শেষ নাগাদ বাস্তবায়ন করার আশা রয়েছে।’
এই পরিকল্পনায় কী আছে জানতে চাইলে ড. শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে, দেশের অন্তত ৬০ শতাংশ কুকুর ও বিড়ালকে বন্ধ্যত্বকরণের আওতায় আনা হবে। এতে সংখ্যা খুব বেশি বাড়বে না, আবার কমেও যাবে না—এমন ভারসাম্য বজায় রাখাই লক্ষ্য। পাশাপাশি, বাসা-বাড়িতে কীভাবে এসব প্রাণিকে সুষমভাবে লালন-পালন করা যায়, সে বিষয়েও দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।’