জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে শেখ হাসিনার মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। পরে আগামী ৩ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের সূচনা বক্তব্য ও আগামী ৪ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছে টাইব্যুনাল।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ শেখ হাসিনাসহ তিনজনের অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন।

এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অভিযোগ গঠনের সময় এ মামলায় একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আদালত বলেন, এ মামলায় আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে আপনার মতামত কী? জবাবে ছোট একটি চিরকুট বের করে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালে হত্যা-গণহত্যা সংঘটনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য। এ ঘটনায় আমি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছি। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিস্তারিত আদালতে তুলে ধরতে চাই। রহস্য উন্মোচনে আদালতকে সহায়তা করতে চাই।’

এ সময় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ আদালতে বলেন, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন যেহেতু দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হতে চান তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা জরুরি। পরে আদালত বলেন, এ বিষয়ে আমরা নির্দেশনা দিব। 

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে গত ৭ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের শুনানি শেষে আজ আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়। মামলায় অন্য আসামি হচ্ছেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আজ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, তাঁকে যে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য কী? তিনি তাঁর দোষ স্বীকার করেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই অপরাধের সবকিছু তাঁর জানার কথা। সব তথ্য উদঘাটনের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তার মাধ্যমে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ হতে চেয়েছেন। সেই প্রার্থনা ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করেছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, সুতরাং চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরবর্তী সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে সুবিধাজনক সময়ে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনাসহ অপরাধ কাদের মাধ্যমে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সেই তথ্য উদঘাটনে সাহায্য করবেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, আইনের ভাষায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’হয়েছেন। বাংলায় এটিকে ‘রাজসাক্ষী’ বলে। অ্যাপ্রুভার হিসেবে তাঁর আবেদন ছিল। সে হিসেবে তিনি গণ্য হবেন। তিনি এখন কারাগারেই থাকবেন। বক্তব্য গ্রহণের পর তাঁর বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

যেহেতু চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অ্যাপ্রুভার হয়েছেন, সে কারণে তাঁর নিরাপত্তা-সংকট হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই আশঙ্কায় তাঁর আইনজীবী আবেদন জানিয়েছেন, তাঁকে যেন যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সেই নিরাপত্তার ব্যাপারেও যথাযথ আদেশ দেবেন বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে গত ৭ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের শুনানি শেষে আজ আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়।

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যে পাঁচ অভিযোগ গঠন-

অভিযোগ-১

গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পর আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং সরকারের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উসকানি ও সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। এই হামলায় হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক আচরণ করা হয়। শেখ হাসিনাসহ উল্লেখিত ব্যক্তিরা এই সব অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, সহায়তা, এবং অপরাধ দমনে ব্যর্থতার জন্য অভিযুক্ত।

অভিযোগ-২

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের অধীনস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করেন। এই ঘটনাগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যা তাদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগ-৩

২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পর তার নির্দেশনায় ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।

অভিযোগ উঠেছে, শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক ও পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের অংশ হিসেবে, আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে স্বল্প দূরত্ব থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বুকে একাধিক গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে ও তাদের সরাসরি নির্দেশনা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ-৪

শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা মহানগরীর চাঁনখারপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে ও তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগ-৫

শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র ছয় ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মরদেহ ও ১ জনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

গত ১৬ জুন এ মামলায় পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় বর্তমানে গ্রেপ্তার রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এখনও পলাতক রয়েছেন।

এই তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ উপস্থাপন করেন প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন। গত ২৪ জুন পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। এর আগে গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এই অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জমা দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।