বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না, গুলিবিদ্ধদের ভর্তি না করতে চাপ দেয় ডিবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় করা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আজও চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম সাক্ষী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোট্রমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান তার জবাবনবন্দিতে বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে। রোগীদের মাথায়, হাতে, পায়ে, পিঠে, মুখে, গলায় গুলি ও পিলেট বিদ্ধ ছিল। ৪ ও ৫ আগস্ট আসা রোগীদের অধিকাংশের মাথায়, বুকে, মুখে ও গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল, বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না। একপর্যায়ে ডিবির লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধদের ভর্তি না করার জন্য আমাকে চাপ দেন।
সাক্ষীর জবানবন্দি এ ডাক্তার বলেন, ‘আমার নাম ডা. মো. মাহফুজুর রহমান। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪৭ বছর। আমি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিউরোট্রমা বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে কর্মরত আছি। ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার বিষয়ে জানার পরে আমি ডিরেক্টর মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শ করি যে, আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ডিরেক্টর মহোদয়ের নির্দেশনায় একটি ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়।’
ডা. মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে। রোগীদের মাথায়, হাতে, পায়ে, পিঠে, মুখে ও গলায় গুলি এবং পিলেটবিদ্ধ ছিল। গুলিগুলো ছিল বড় সাইজের। ৪ ও ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে যে রোগীরা আসে, তাদের অধিকাংশের মাথায়, বুকে, মুখে ও গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল। বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না। আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহিঃবিভাগে চিকিৎসা প্রদান করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। চারজনকে আনা হয় মৃত অবস্থায়। ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়।’
‘১৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে যখন রোগী বেড়ে যাচ্ছিল, তখন ডিবির লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য আমাকে চাপ দেন। তারা বলেন—আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন। তারা আরও বলেন, যাদের ভর্তি করেছেন তাদেরকে রিলিজ করবেন না, এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে’, যোগ করেন নিউরোসায়েন্স হসপিটালের এই চিকিৎসক।
ডা. মো. মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, ‘তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্ট্রারে রোগীদের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড এক্সিডেন্ট (সড়ক দুর্ঘটনা) বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি। আমার রোগীদের বয়স ছিল ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাদের অধিকাংশই ছিল শিক্ষার্থী। আমি প্রায় ৩৫টি অপারেশন করি এবং অনেকগুলো বুলেট আহতদের শরীর থেকে বের করেছি। যেসব রোগীদের মাথার খুলি ছিল না, তাদের কয়েকজন আইসিইউতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। তাদের মধ্যে টিভির একজন সাংবাদিকও ছিল।’
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং যারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছে, আমি তাদের বিচার ও ফাঁসি চাই। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই হলো আমার জবানবন্দি।’